পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার মংপুর রবীন্দ্রনাথ

অনলাইন ডেস্ক: পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার মংপুতে আছেন এক রবীন্দ্রনাথ। জীবনের একেবারে শেষবেলায় তিনি এখানে কয়েক দফা এসে বাস করে গেছেন। রেখে গেছেন এমন অমূল্য কিছু স্মারক, যার খোঁজ হয়তো রবীন্দ্র-অনুরাগীদেরও অনেকের অগোচর রয়ে গেছে। ২০১৬ সালে মংপু গিয়ে ‘রবীন্দ্র ভবন’ নামের সংগ্রহশালাটিতে এমন অদৃষ্টপূর্ব কিছু সংগ্রহ আর তাদের অনাদর–অবহেলা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। এরপর যথারীতি বিস্মৃতও হয়েছিলাম। সম্প্রতি মংপুর স্মৃতি ফিরে এল দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে। এক. এ বছর জুলাই মাসে জানা গেল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেরিটেজ কমিশন ভবনটির সংস্কার করে যথাযথ সংরক্ষণ এবং একে রবীন্দ্র গবেষণার একটি কেন্দ্রে পরিণত করার সংকল্প ঘোষণা করেছেন। তবে চোরের দল সম্ভবত ওই সংকল্পটি আগেই করে ফেলেছিল। ফলে, দুই নম্বর তথ্য—দিনকয়েক আগে কাগজে দেখলাম মংপুর সংগ্রহশালা থেকে চুরি হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের আঁকা আসল ছবি, ছবি আঁকার রং-তুলি-কালি, পাণ্ডুলিপি, তাঁর শখের হোমিওপ্যাথির সরঞ্জাম, দুর্লভ আলোকচিত্রসহ নানা কিছু।

দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে, মৈত্রেয়ী দেবীর অতি-সুখপাঠ্য মংপুতে রবীন্দ্রনাথ পড়ার কারণেই সম্ভবত, মংপু দেখার আকর্ষণ রোধ করা গেল না। পাঠ্যবই সূত্রে আমাদের জানা আছে যে সিঙ্কোনাগাছের ছাল থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন পাওয়া যায়। ভারতে প্রথম কুইনাইন বড়ি তৈরির কারখানা স্থাপিত হয় মংপুতে ১৮৬৪ সালে, কারণ সিঙ্কোনাগাছ এ অঞ্চলেই বিশেষভাবে পাওয়া যায়। মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী মনমোহন সেন ছিলেন এখানে কর্মকর্তা এবং কারখানার প্রবেশপথের উল্টো দিকেই ছিল তাঁর বাংলো। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চারবার এ বাংলোতে এসে বাস করেছেন। ১৯৪০ সালে শেষবারের মতো জন্মদিন উপলক্ষে এখানে বসেই তিনি রচনা করেন ‘জন্মদিন’ নামের কবিতাটি এবং এটি কলকাতা রেডিওতে সরাসরি প্রচারের জন্য তিনি কালিম্পং থেকে টেলিফোনে কবিতাটি আবৃত্তিও করেন।

অকুস্থলে এসে দেখলাম এপার আর ওপারের একই দুরবস্থা। সিন্থেটিক কুইনাইন আবিষ্কার হওয়ার ফলে সিঙ্কোনা-জাত কুইনাইনের আর তেমন চাহিদা নেই, এতে কারখানাটির এহেন দীর্ণদশা। আর রবীন্দ্রনাথ গত হওয়ার ৭৫ বছর পর অযত্নে–অবহেলায় এ পারের রবীন্দ্র কুটিরটিও দীনহীন ভগ্ননীড়। ভবনটি তালাবদ্ধ, বিস্তর হাঁকডাকের পর এক নেপালি দারোয়ান গোছের মানুষ জানালেন ভবনের তত্ত্বাবধায়ক বাসায় আছেন। তবে তিনি তালা খুলে দেখাতে পারেন। সেটি ভালোই হলো। কারণ সংগ্রহশালায় রক্ষিত প্রতিটি বস্তু বিষয়ে এ নিতান্ত স্বল্পশিক্ষিত মানুষটির জ্ঞানের বহর দেখে আমাদের তাক লেগে গেল।

সংগ্রহশালায় রাখা আছে রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার রঙ-তুলি-কালি, আঁকা ছবি, হোমিওপ্যাথির নানা আকারের শিশি, পাণ্ডুলিপি আর আমাদের অদেখা অসংখ্য আলোকচিত্র। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে মোটামুটি জানা-দেখা থাকা সত্ত্বেও এসব আলোকচিত্র আমি আগে দেখিনি। রয়েছে তাঁর নিজের নকশা করা আসবাবপত্র। স্নানের সুবিধার জন্য স্নানঘরে নিজের নকশায় ঠান্ডা ও গরম পানি সরবরাহের কৌতূহলোদ্দীপক ব্যবস্থাটি কবির সৃজনশীল মানসের আরেকটি পরিচয়। তুলি রাখার একটি বাঁশের দানি দেখলাম, যার গায়ে খোদাই করে এবং তার কালি ঘষে ছবি ফুটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর এমন সৃষ্টির কথা জানাই ছিল না।

কিন্তু ভবনটির অবস্থা করুণ, ছাদের কোণ দিয়ে পানি পড়ছে, মোটামুটি ভেঙে পড়ার দশা। আসবাবপত্র ও আলোকচিত্রগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়।

তবে মংপুর এই ভবনটি থেকে চুরি হওয়া মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না বলে মনে হয়। কারণ রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারই েতা চুরি হয়েছে। বঙ্গদেশে যে স্থানগুলোতে এমন সংগ্রহ রয়েছে—বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবন, কলাভবন বা রবীন্দ্রভারতীর সংগ্রহ ইত্যাদির নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েও উদ্বেগ আছে। আমাদের দেশেও শিলাইদহে রয়েছে রবি ঠাকুরের স্মৃতিধন্য কিছু অমূল্য স্মারক। এ ধরনের সংগ্রহের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদেরও কিছু শৈথিল্য রয়েছে। কয়েক বছর আগে ময়মনসিংহের জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা থেকে তাঁর বিখ্যাত দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রমালার বেশ কয়েকটি চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনা আশা করি দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিস্মৃত হননি।

আমাদের ইতিহাসের মূল্যবান সম্পদরাশির অধিকাংশই আমরা হারিয়েছি, এগুলো দেখতে আমাদের যেতে হয় পশ্চিমের জাদুঘরে। এ সব সম্পদের যেটুকু আমাদের দেশে রয়েছে তার নিরাপত্তায় যেন আমরা আরও যত্নবান হই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *