‘মাছের খনি’ পেল বাংলাদেশ

অনলাইন ডেস্ক: ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তি হওয়ার পর বঙ্গোপসাগরের আরও ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ অধিকৃত বর্ধিত এই সমুদ্রাঞ্চলে গবেষণা চালিয়ে ইতোমধ্যেই ৪৩০ প্রজাতির বিপুল পরিমাণ মাছের সন্ধান পেয়েছে সরকার। এই ‘মাছের খনি’ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রসঙ্গত, দেশের মিঠাপানিতে রয়েছে মাত্র ২৫০ প্রজাতির মাছ। আর আগের করা বিভিন্ন গবেষণার ফল বলছে, বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে মৎস্য আহরিত হয় ৪২ লাখ ৭৭ হাজার টন। এর মধ্যে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন ইলিশ রয়েছে। সমুদ্র সম্পদের সঠিক জরিপের মাধ্যমে মৎস্য আহরণ আগামীতে অনেক বেড়ে যাবে।

এ ছাড়া প্রতিবছর এ অঞ্চল থেকে ৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন মাছ আহরিত হলেও এর মধ্যে মাত্র ০ দশমিক ২৯ মিলিয়ন টন মাছের হিসাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যোগ হয়। বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ছোট ট্রলার ও নৌকা মাছ আহরণে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই তুলনায় বড় ট্রলার নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে নজর দিয়েছে সরকার। দেশের মৎস্যজীবীদের জন্য বড় ট্রলারসহ আর্থিক সহায়তা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামে বিশ্বমানের ৩টি অ্যাক্রিডিটেড ল্যাবরেটরি পরিচালনা করা হচ্ছে। ২০১৭-১৮ সালে ৬৮ হাজার ৯৩৫ টন সামুদ্রিক মাছ রপ্তানির মাধ্যমে দেশের আয় হয়েছে ৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। হিমায়িত ও জীবন্ত এসব সামুদ্রিক রপ্তানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে চিংড়ি (হিমায়িত, কুকড ও বরফায়িত), মাছ (হিমায়িত ও বরফায়িত), কুচিয়া/ইল (জীবিত), কাঁকড়া (জীবিত ও হিমায়িত), শুঁটকি ও লবণাক্ত শুঁটকি, হাঙ্গরের পাখনা ও মাছের আঁশ। বাংলাদেশের মাছ বিশ্বের ৫৬ দেশে রপ্তানি হচ্ছে। সর্বাধিক মাছ রপ্তানিকৃত ১০ দেশ হলো-নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান ও রাশিয়া। মাছ ও চিংড়ির পণ্যে রেসিডিউ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমের সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালের এপ্রিলে ইইউ মিশনের সুপারিশে ইইউভুক্ত দেশে বাংলাদেশের মৎস্যপণ্য রপ্তানিতে টেস্ট সার্টিফিকেট জমাদানের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জরিপ জাহাজ পরিচালনার মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের অধিক টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল=১.১৫ মাইল) একচ্ছত্র অর্থনৈতিক (ইইজেড) অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ অঞ্চলে ২০১৬ সালে আরভি মীন সন্ধানী নামে বিশেষায়িত একটি গবেষণা জাহাজ সরকারের তরফে জরিপ কাজ শুরু করে। ২১টি সার্ভে ক্রুজ-পরিচালনার মাধ্যমে এখানে ৪৩০টি প্রজাতির মাছ চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র আরও জানায়, ষাটের দশকে জাপানের সহায়তায় বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্যের প্রজাতি, পরিমাণ, মজুদ ও আহরণের বিষয়ে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ অংশে জরিপ কাজ পরিচালনা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া) সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর ট্রলারবহরের মাধ্যমে উপকূলীয় ২শ নটিক্যাল মাইল বা ইইজেড এলাকায় জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, ৪৭৫টি সামুদ্রিক মাছ, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি ও ৪টি মৎস্য বিচরণ কেন্দ্র রয়েছে। এর পর ১৯৮৩-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) সহায়তায় আরভি অনুসন্ধানী ও এমভি মাছরাঙ্গা দিয়ে জরিপ চালানো হয়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এসব জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই চলছিল সব কর্মকা-। এর পর ২০১৬ সালে সরকার সার্ভে জাহাজ ‘আরভি মীন সন্ধানী’ অধিকৃত সাগরে পাঠানোর পরই দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ জরিপ কাজ শুরু হয়। যার সুফল ঘরে আসা শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, সর্বশেষ ১৯৮৭ সালের জরিপের ওপর ভিত্তি করেই এতকাল মাছ ধরা হতো। এর পরও বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে জরিপ হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। আশার কথা হলো, নীল অর্থনীতির উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নতুন জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শুধু মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রেই নয়, প্রাণিজ-অপ্রাণিজসহ অধিকৃত সমুদ্রের সব সম্পদের যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে পুরো দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বিশদ পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *