‘এই ১০ তথ্য মাথায় রাখলে কমে যাবে করোনার ভয়’

অনলাইন ডেস্ক : চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস প্রায় বৈশ্বিক মহামারি আকার ধারন করেছে। মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রাণঘাতি এই ভাইরাস বিশ্বের ১০৯টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়াটা অযৌক্তিক কিছু নয়।

তবে একথাও ঠিক যে অত বেশি আতঙ্কিত হওয়ারও বেশি কারণ নেই। কেননা ওষুধ না থাকলেও এই ভাইরাস প্রতিরোধে রয়েছে কার্যকর কিছু জীবনাচরণগত পদ্ধতি। এছাড়াও এমন কিছু তথ্য রয়েছে যেগুলো জানা থাকলে আপনার ভয় অনেক কমে যাবে। আসুন জেনে নেওয়া যাক এমন ১০টি তথ্য…

১. আমরা জানি এটা ঠিক কী ধরনের ভাইরাস
এইডস ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রথম ধরা পড়েছিলো ১৯৮১ সালের জুন মাসে। কিন্তু এইচআইভি ভাইরাসটি শনাক্ত করতে সময় লেগেছিলো ২ বছরেরও বেশি সময়।

আর এই কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত তীব্র নিউমোনিয়া রোগী প্রথম ধরা পড়ে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। এরপর মাত্র ৮ দিনেই- ৭ জানুয়ারি ভাইরাসটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়। আর দশম দিনেই ভাইরাসটির জেনোম সিকোয়েন্সও বের করে ফেলেন বিজ্ঞানীরা।

আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছি এটি গ্রুপ ২বি থেকে আসা একটি নতুন করোনাভাইরাস। যা সার্স (SARS) পরিবারভুক্ত, যার নাম SARSCoV2। আর নতুন এই করোনাভাইরাসের নাম Covid-19।

ধারণা করা হয় নতুন এই করোনাভাইরাস বাদুড়ের দেহ থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করেছে। জেনেটিক বিশ্লেষণ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে প্রাকৃতিকভাবেই এই ভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসের শেষ দিক থেকে শুরু করে ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে এর উৎপত্তি হয়। আর কোনো ভাইরাস সাধারণত ব্যাপকভাবে মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেকে টিকিয়ে রাখে। তবে আশার কথা হলো নতুন এই করোনাভাইরাসের মিউটেশনের হার খুব বেশি নয়।

২. আমরা জানি কীভাবে এই ভাইরাস শনাক্ত করতে হয়
গত ১৩ জানুয়ারি থেকেই এই ভাইরাস শনাক্ত করার পদ্ধতি জেনে গেছেন চিকিৎসকরা।

৩. চীনে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে
কড়া নিয়ন্ত্রণ এবং রোগীদেরকে জনসাধারণ থেকে আলাদা করে ফেলার পদ্ধতি প্রয়োগ করে এই ভাইরাস প্রতিরোধে চীন ভালো সাফল্য পেয়েছে। গত কয়েকসপ্তাহ ধরে চীনে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কমে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশও চীনের পদ্ধতি অনুসরন করে সাফল্য পাচ্ছে। যেসব এলাকায় এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে সেসব এলকাতেই সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছে অন্যান্য দেশগুলোও।

৪. ৮১ শতাংশ ক্ষেত্রেই করোনার আক্রমণ তীব্র নয়
করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৮১ শতাংশের ক্ষেত্রেই তেমন কোনো বড় লক্ষণ দেখা দিচ্ছে না বা বড় কোনো অসুস্থতা হচ্ছে না। তবে ১৪ শতাংশের ক্ষেত্রেই এই ভাইরাস ভয়াবহ আকার ধারণ করছে এবং তীব্র নিউমোনিয়া ও ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত করছে। আর ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস মৃত্যু ডেকে আনতে পারে বা আনছে।

৫. করোনায় আক্রান্তরা সুস্থ হচ্ছেন
এই ভাইরাসে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার ১৩ গুন মানুষ সুস্থ হয়ে গেছেন। আর এখন সুস্থ হওয়ার হার আরো বাড়ছে।

৬. শিশুদের কিছুই করতে পারছে না এই ভাইরাস
করোনাভাইরাসে যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মাত্র ৩ শতাংশের বয়স ২০ বছরের নিচে। আর আক্রান্তদের মধ্যে যাদের বয়স ৪০ বছরের নিচে তাদের মাত্র ০.২ শতাংশ মানুষ মারা গেছেন। এছাড়া শিশুদেরকে এই ভাইরাস কিছুই করতে পারছে না।

৭. এই ভাইরাস সহজেই ধুয়ে ফেলা যায়
ইথানলের সলিউশনযুক্ত (৬২-৭১% অ্যালকোহল আছে এমন) তরল, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডযুক্ত (০.৫% হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড আছে এমন) তরল অথবা সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইটযুক্ত (০.১% ব্লিচ) দিয়ে মাত্র ১ মিনিটের মধ্যেই এই ভাইরাস ধুয়ে মেরে ফেলা যায়।

বারবার সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুয়ে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচা যায়।

৮. বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাস নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন
বর্তমান যুগ হলো আন্তর্জাতিকভাবে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার যুগ। মাত্র এক মাসের মধ্যেই এই ভাইরাস নিয়ে ১৬৪টি কার্যকর বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এই ভাইরাসের টিকা, চিকিৎসা এবং মহামারি সংক্রান্ত বিদ্যা, বংশগতি (জেনেটিকস), রোগনির্ণয় এবং ক্লিনিকাল দিকসহ নানা দিক নিয়ে গবেষণাগুলো হচ্ছে।

অন্তত ৭০০জন বড় বিজ্ঞানী এই গবেষণাযজ্ঞে অংশ নিয়েছেন। অথচ ২০০৩ সালে ছড়ানো সার্স ভাইরাস নিয়ে এর অর্ধেক গবেষণা করতেও এক বছরের বেশি সময় লেগেছিলো। আর সবচেয়ে বড় সুখবর হলো বেশিরভাগ বিজ্ঞান জার্নালগুলো তাদের প্রকাশিত গবেষণা জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করে দিয়েছে।

৯. ইতিমধ্যেই এই ভাইরাসের নমুনা টিকা আবিষ্কার হয়েছে
নতুন এই করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারে ইতিমধ্যেই ৮টি বড় আকারের গবেষণা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এই বড় ৮টি গবেষণা প্রকল্প ছাড়াও আরো অসংখ্য গবেষণা প্রকল্পে এই ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, তারা চুড়ান্তভাবে এই ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। ‘মলিকিউলার ক্ল্যাম্প’ নামের কৌশল ব্যবহার করে তারা এই ভাইরাসের টিকার একটি ‘প্রোটোটাইপ’ আবিষ্কার করে ফেলেছেন। যা শিগগিরই হয়তো মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখা হবে। হয়তো রেকর্ড পরিমাণ কম সময়ের মধ্যেই এই ভাইরাসের টিকা আবিষ্কৃত হয়ে যাবে।

১০. এর চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিভাইরাল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে
ভ্যাকসিন হলো ভাইরাসকে চুড়ান্তভাবে প্রতিরোধ করা জন্য। কিন্তু এখন যারা অসুস্থ তাদের চিকিৎসা দেওয়াটা জরুরি। করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিয়ে ৮০টিও বেশি প্রকল্পে গবেষণা ও ক্লিনিকাল ট্রায়াল বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। অন্যান্য ভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিভাইরাল ওষুধগুলো দিয়ে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। যেগুলো নিরাপদও বটে।

এর মধ্যে একটি অ্যান্টিভাইরাল হলো রেমডেসিভির (remdesivi) যা ইতিমধ্যেই মানবদেহে পরীক্ষা করে দেখা হয়ছে। এই অ্যান্টিভাইরালটি ইবোলা এবং সার্স ও মার্স ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিলো। এটি নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।

এই তালিকায় আরেকটি অ্যান্টিভাইরাল হলো ‘ক্লোরোকোয়াইন (chloroquine)’। যা মূলত ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়েছে। ‘এনডোসোম’ এর পিএইচ (pH) এর মাত্রা বড়িয়ে দিয়ে ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করে এই ‘ক্লোরোকোয়াইন’। কোষের সঙ্গে ভাইরাসের ফিউশনের জন্য দরকার হয় এন্ডোসোম। আর এন্ডোসোম এর পিএইচ বাড়িয়ে দিলে তা আর সম্ভব হয় না। ভাইরাসও টিকতে পারে না শরীরে।

আশার কথা হলো ‘ক্লোরোকোয়াইন’ ইতিমধ্যেই নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নিউমোনিয়া রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এই অ্যান্টিভাইরাল উপাদানটি করোনাভাইরাসকেও ঠেকিয়ে দিচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এছাড়া ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ‘ওজেলটামিভির (oseltamivir)’, ‘ইন্টারফেরন-১বি (interferon-1b: অ্যান্টিভাইরাল প্রোটিন) এবং ‘অ্যান্টিসেরা (antisera)’ নামের কয়েকটি অ্যান্টিভাইরাল উপাদান নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেও কাজে লাগানো হচ্ছে।

১৯৮১ সালে ফ্লু ভাইরাসে বিশ্বব্যাপী মাত্র ২৫ সপ্তাহে আড়াই কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো। এবারও কি তেমনটা ঘটতে পারে? সম্ভবত না। এর আগে আর কখনো কোনো ভাইরাস মোকাবিলায় এতোটা বেশি প্রস্তুত ছিলো না মানবজাতি।

সুতরাং এই ভাইরাস নিয়ে অতি বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

সূত্র: আই নিউজ.কো.ইউকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *