করোনাভাইরাস লক্ষণ : স্বাদ-গন্ধ কমলেই রেড এলার্ট

অনলাইন ডেস্ক : ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিডল্যান্ডস হাসপাতালের ফিজিওথেরাপিষ্ট ড্যানের নাক দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হতে শুরু করলে, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন তার হে-ফিভার অর্থাৎ ফুলের রেণু থেকে এলার্জি হয়েছে।

কিন্তু যখন পাউরুটির সাথে টম্যাটো সসে সেদ্ধ শিমের বিচি খাওয়ার সময় তিনি কোনো গন্ধ পেলেননা, তখন ২৩ বছরের এই যুবক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন।

“আমি ধরেই নিলাম, অন্য কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে। ঢক ঢক করে পুরো এক গ্লাস অরেঞ্জ স্কোয়াশ খেলাম, কিন্তু এবারও কোনো গন্ধই পেলাম না।“

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ ঢুকলো তার মনে। জরুরী স্বাস্থ্য হেল্পলাইন ১১১-এ ফোন করলেন তিনি, কিন্তু “গায়ে জ্বর বা কাশি নেই” শুনে তারা বললো, কোনো চিন্তা নেই।

“তারা বললো তুমি কাজে যেতে পারো, সমস্যা নেই। কিন্তু হঠাৎ করে স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি চলে যাওয়া নিয়ে আমি একেবারেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, এটা কাকতালীয় হতে পারেনা।“

স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ড্যান বাড়িতে আইসোলেশনে চলে যান। বাড়িতে মা এবং বোন। মা বয়স্কদের পায়ের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন, আর বোন একটি শিশু হাসপাতালের আইসিইউ নার্স।

তার উদ্বেগের কথা শুনে ড্যানের ম্যানেজার তার করনোভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। কিছুদিন পর ফলাফলে দেখা গেল তিনি কোভিড-১৯ পজিটিভ।

“আমি যদি সরকারের কথা শুনে কাজে যাওয়া অব্যাহত রাখতাম, রোগীদের নিয়ে কাজ করতাম – তাহলে হয়তো অনেকের দেহে আমার কাছ থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তো।“

এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বা এনএইচএস শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা এবং ঘন-ঘন কাশিকেই কোভিডের অন্যতম প্রধান দুই উপসর্গ হিসাবে বিবেচনা করছে।

কিন্তু একের পর এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে জ্বর বা কাশি শুরুর আগেই তারা স্বাদ-গন্ধ হারিয়ে ফেলছে।

ব্রিটিশ রিনোলজিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট এবং শীর্ষ নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ক্লেয়ার হপকিন্স বলছেন, জ্বর বা কাশির চেয়েও হঠাৎ স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি চলে যাওয়া কোভিডের আরো ‘বিশ্বাসযোগ্য‘ উপসর্গ হতে পারে।

কেন সরকার এখনও এই উপসর্গকে গুরুত্ব দিচ্ছেনা তা নিয়ে তিনি এবং তার অনেক সহকর্মী হতাশ।

গত প্রায় দুই মাস ধরে প্রফেসর হপকিন্স বলে চলেছেন যে স্বাদ-গন্ধ কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখলেই মানুষকে দ্রুত আইসোলেশনে যাওয়ার পর পরামর্শ দেওয়া উচিৎ।

গত ১৯শে মার্চ ব্রিটেনের নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞদের সমিতির পক্ষ থেকে প্রথম একটি প্রেস-বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে বলা হয়, কোভিড রোগীরা স্বাদ-গন্ধ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন।

প্রফেসর হপকিন্স বলছেন, “দুই মাস আগে আমরা শুধু সন্দেহ করছিলাম, কিন্তু এখন এই সন্দেহ প্রমাণ হিসাবে বিবেচনার দাবি রাখে।“

স্বাদ-গন্ধ চলে যাওয়ার একমাত্র উপসর্গ

প্রফেসর ক্লেয়ার হপকিন্স বলছেন, কোভিডে আক্রান্ত হলে হঠাৎ করেই রোগীর স্বাদ-গন্ধ চলে যেতে পারে। সর্দিতে নাক বন্ধ না হলেও এটা ঘটতে পারে।

ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার একদম শুরুতেই এই উপসর্গ হাজির হতে পারে, অথবা অন্য উপসর্গের সাথে সমান্তরালভাবেও এটি দেখা দিতে পারে।

তিনি বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাদ-গন্ধ নষ্ট হওয়াটাই একমাত্র উপসর্গ হিসাবে দেখা দিচ্ছে। রোগীরা খেতে পারছেনা। প্রফেসর ক্লেয়ার বলছেন, ৪০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যাচ্ছে।

তবে ব্রিটেনের স্বাস্থ্য বিভাগ এখনও খতিয়ে দেখছে যে স্বাদ-গন্ধ হারানোকে করোনাভাইরাসের উপসর্গের তালিকায় ঢোকানো উচিৎ কিনা।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ফ্রান্স এরই মধ্যে হঠাৎ স্বাদ-গন্ধ নষ্ট হওয়াকে কোভিডের উপসর্গের তালিকায় জায়গা দিয়েছে।

প্রমাণ মিলছে একের পর এক গবেষণায়

একের পর এক গবেষণাও বলছে, কোভিডে আক্রান্তদের সিংহভাগই স্বাদ-গন্ধ চলে যাওয়ার কথা বলছে।

লন্ডনের কিংস কলেজের তৈরি একটি করোনাভাইরাস ট্র্যাকার অ্যাপের মাধ্যমে পাওয়া ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এই অ্যাপ ব্যবহারকারিদের মধ্যে যারা কোভিড রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ৫৯ শতাংশই বলেছেন, তারা হঠাৎ করেই নাকে গন্ধ পাচ্ছেন না, জিভে স্বাদ পাচ্ছেন না।

কিংস কলেজ ও ইংল্যান্ডের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের অ্যাপ ব্যবহারকারিদের মধ্যে যে প্রায় সাত হাজার লোক পরীক্ষায় কোভিড পজিটিভ হয়েছেন, তাদের ৬৫ শতাংশই বলছেন তাদের স্বাদ-গন্ধ নেবার ক্ষমতা চলে গিয়েছিল।

ঐ গবেষকরা বলছেন, জ্বরের চেয়ে স্বাদ-গন্ধ হারানো কোভিডের আরো নিশ্চিত একটি উপসর্গ হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিৎ।

গন্ধ ফিরে পেতে লাগতে পারে দেড় বছর

ব্রিটেনের নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ক্লেয়ার হপকিন্স বলছেন, আক্রান্ত হওয়ার সাত থেকে ১৪ দিনের মধ্যে স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি ফিরে আসছে। কিন্তু ১০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগছে।

তিনি বলছেন, ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা চিরতরে চলে যেতে পারে। কখনো কখনো তা ফিরে পেতে দেড় বছর লেগে যেতে পারে।

এ নিয়ে ইটালি, ফ্রান্স, স্পেন এবং বেলজিয়ামের কয়েকজন ডাক্তারের সাথে কাজ করছেন প্রফেসর হপকিন্স । তারা সবাই একমত হয়েছেন যে, মাথায় আঘাত না পেয়েও বা সর্দিতে নাক বন্ধ না হলেও কেউ যদি হঠাৎ স্বাদ-গন্ধ হারিয়ে ফেলেন, তাহলে তার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

“গবেষনায় আমরা দেখেছি অন্য কোনো উপসর্গ ছাড়াই যারা স্বাদ-গন্ধ হারাচ্ছেন, তাদের কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশেরও বেশি।“

প্রফেসর হপকিন্স বলছেন, জ্বরই বরং কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার খুব নির্ভরযোগ্য উপসর্গ নয়, কারণ নানা কারণে মানুষের জ্বর হতে পারে, এবং কোভিডে আক্রান্তদের মধ্যে বড়জোর ৪০ শতাংশের জ্বর হচ্ছে।

উপসর্গ নিয়ে আরো একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পের সাথে জড়িত ছিলেন প্রফেসর হপকিন্স। চার হাজারেরও বেশি কোভিড রোগীর ওপর চালানো ঐ গবেষণায় দেখা গেছে, রোগীদের গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা ৮০ শতাংশ কমে গেছে। স্বাদ নেয়ার ক্ষমতা কমে গেছে ৬৯ শতাংশ।

প্রফেসর হপকিন্স মনে করেন, স্বাদ-গন্ধ কমে যাওয়ার পরও জরুরী সেবায় নিয়োজিত যেসব লোকজন কাজ করে গেছেন, তারা হয়ত ভাইরাস ছড়ানোর পেছনে ভূমিকা রাখছেন।

“এমন অনেক কর্মী আমাদের বলেছেন যেহেতু স্বাদ-গন্ধ কমে যাওয়ার উপসর্গকে সরকার বিবেচনা করছে না, সুতরাং তাদের কাজ করে যেতে হচ্ছে, তাদের ছুটি দেওয়া হচ্ছেনা।“

তবে ব্রিটেনে সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন যেসব বিশেষজ্ঞ – তারা এখনও ঐক্যমত্যে পৌঁছুতে পারছেননা যে স্বাদ-গন্ধ হারানোর উপসর্গকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।

ওদিকে তার স্বাদ-গন্ধের ক্ষমতা ফিরে আসছে কিনা তা বুঝতে ড্যান এখন প্রতিদিনই লবন-ভিনিগার মেশানো আলুর চিপস খাচ্ছেন। তিনি বলছেন, স্বাদ কিছুটা ফিরলেও, গন্ধ এখনও ঠিকমতো পাচ্ছেন না।

“রান্নার সময় আমি যখন রসুন দিচ্ছি, অন্যরা বলছে তারা কড়া গন্ধ পাচ্ছে, কিন্তু আমার নাকে গন্ধ আসছে খুবই কম।“

সূত্র : বিবিসি বাংলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *