অনলাইন ডেস্ক: গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে-তুং যুগের পর কয়েক দশক ধরে চীনের নাগরিকদের মধ্যে স্বর্ণ ক্রয় ছিল নিষিদ্ধ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল স্বর্ণের বাজারে একমাত্র ভোক্তা। ছিল কেবল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কয়েকটি কোম্পানি। ২০০০ সালের শুরুতে এসে উঠিয়ে নেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। চালু হয় স্বর্ণ কেনাবেচার স্থান সাংহাই এক্সচেঞ্জ।
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বর্ণ ক্রয়–বিক্রয়ের স্থান হলো সাংহাই এক্সচেঞ্জ। যে কাউকে এই বাজারে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের দিকে ক্রেতা ও বিক্রেতার সমারোহে চীনের এই স্বর্ণের বাজার হয়ে ওঠে রমরমা। পশ্চিম থেকে স্বর্ণের বার গলিয়ে ছোট ছোট পাত আকারে পাঠানো হতো পূর্বে। থমসন রয়টার্সের গবেষণা ইউনিট জিএফএমএস বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সময়টাতে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের বেচাকেনা হয়।
সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীতে চীনের এই স্বর্ণ বাজার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কীভাবে স্বর্ণের চাহিদার ধরনে পরিবর্তন এসেছে, তা উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে।
২০১৩ সাল থেকে চীনের স্বর্ণের চাহিদা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের যৌথ চাহিদার চেয়ে বেশি। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী চীন বিশ্বের বৃহত্তম স্বর্ণের গ্রাহক, বিশ্ব বাজারের ৩০ শতাংশ চাহিদা চীনের।
২০০৭ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশ চীন। ওই বছর দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে এই শীর্ষ স্থানে যায় চীন। এরপর গত ১১ বছর এই স্থান ধরে রেখেছে তারা। বছরে প্রায় ৪২৬ টন স্বর্ণ খনি থেকে উত্তোলন করে চীন। তবে দেশটির প্রয়োজন হয় ১ হাজার ৮৯ টন স্বর্ণ। চাহিদা বাড়ায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘চায়না গোল্ড’ এবং ‘শান দং গোল্ড’ সম্প্রতি স্বর্ণের দোকানের শাখা বাড়িয়েছে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের সদস্য রোল্যান্ড ওয়াং বলেন, চাহিদা বাড়ার সময় থেকে স্বর্ণের খুচরা বাজারের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম যাঁরা নতুন বিয়ে করেছেন, তাঁরা সাজসজ্জায় অধিক ব্যয় করছেন।
চীনে যখন স্বর্ণ ক্রয় নিষিদ্ধ ছিল, তখন কেবলমাত্র দক্ষিণাঞ্চলের শেনজেন প্রদেশের একটি অঞ্চলে বাণিজ্যের অনুমতি ছিল। ওটাই এখন মূল উৎপাদনকারী অঞ্চল। অন্যদিকে ফুজিয়ান প্রদেশের পুতিয়ান হচ্ছে খুচরা বাণিজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী অঞ্চল। পুতিয়ানের ব্যবসায়ীরা খুচরা বিক্রির প্রায় এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি উৎপাদন করেন, যার পরিমাণ সাড়ে ছয় শ টন। শহরের প্রধান সড়কেই ২০টির মতো স্বর্ণের দোকান আছে। গোল্ডহোয়ারফ, লাক লাক লাকের মতো স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর বড় শোরুম আছে এখানে।
পুতিয়ান শহরের বেইগাঁওতে প্রতি ১০ জনের ৯ জন স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে প্রায় ১ লাখ মানুষের বসতি। হাওচাং জুয়েলারি হচ্ছে পুতিয়ানের অন্যতম বড় জুয়েলারি সংস্থা। চার প্রজন্ম ধরে ব্যবসা করছেন তাঁরা। পুরো চীনজুড়ে প্রায় কয়েক শ শোরুম আছে তাঁদের। তাঁরা ব্যবসা আধুনিকায়নের ওপর জোর দিচ্ছেন। যদিও প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠরা বলছেন, ২৪ ক্যারেটের হলুদ সোনার পাতের এখনো দাম আছে। তবে তরুণ চীনারা ২৪ ক্যারেটের কাঁচা চকচকে সোনা অতটা পছন্দ করেন না। ক্যারেট নিয়ে খুব বেশি ভাবেন না তাঁরা। অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বল আধুনিক অলংকার পছন্দ করেন। আর তাই চাহিদা বুঝে স্বর্ণকারেরাও কম ক্যারেটের স্বর্ণ ব্যবহারে আরও সৃজনশীল হয়েছেন। চলতি মাসে বেইগাওতে স্বর্ণ শিল্পাঞ্চলের উদ্বোধন হবে।
সম্প্রতি চায়না ডেইলির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, তরুণ ক্রেতাদের মধ্যে স্বর্ণের চাহিদায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। জুয়েলারি প্রস্তুতকারক কোম্পানি গাংলু গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ঝেং হুয়ানজিয়ান বলেন, ‘১ হাজার ইউয়ান খরচ করে যে তরুণ এখন স্বর্ণের গয়না কিনছেন, পরদিন একই দামে তা বিক্রির আশা করেন না তিনি। এই স্বর্ণ ভবিষ্যতে কী কাজে লাগবে, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই তরুণ সমাজের।’
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের পরিচালক শেং ঝিজুং বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে স্বর্ণ মূল্যবান বলেই মানুষ কেনেন। ২০১৩ সালে স্বর্ণের দাম কমে যাওয়ায় বাজারের উৎপাদন সক্ষমতা অত্যধিক বেড়ে যায়। তবে মূল্য নিয়ে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়। ২০১৭ সাল থেকে এই শিল্পে আধুনিকায়ন খুব জরুরি হয়ে পড়ে। বর্তমানের ফ্যাশন প্রবণতার সঙ্গে শুদ্ধ স্বর্ণের সম্পর্কটা ফিকে হয়ে গেছে। ১৮ ক্যারেটের আধুনিক পণ্য তৈরি হচ্ছে, তরুণ সমাজের কাছে যার চাহিদায় বেশি।
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি এখন চীন। উচ্চ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে এগিয়ে রয়েছে দেশটি। তবে স্বর্ণশিল্পের অগ্রগতির জন্য এবং নিজের স্থান ধরে রাখতে এই শিল্পের আধুনিকায়নের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা।