ন্যাশনাল ডেস্ক: টানা তিনবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে দেশ সেরার খেতাব অর্জন করেছে রাজশাহী কলেজ। সোমবার কলেজ পারফরমেন্স র্যাংকিংয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সেরা ৭৬টি কলেজের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে সেরা ৭২.৯৬ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয়বারের মত শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছে রাজশাহী কলেজ।
এর আগে ২০১৫ ও ২০১৬ সালের র্যাংকিংয়েও রাজশাহী কলেজ প্রথমস্থান অর্জন করে। সোমবার দুপুরে গাজীপুরস্থ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে এক সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ এসব তথ্য তুলে ধরেন।জাতীয় পর্যায়ে ‘প্রথম ৫ সেরা কলেজ’ ক্যাটাগরিতে রাজশাহী কলেজের পরে ৬৬.১৫ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে বরিশালের বিএম কলেজ, ৬৬.১১ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ, ৬৫.৯৬ পয়েন্টে চতুর্থ অবস্থানে পাবনা সরকারি অ্যাডওয়ার্ড কলেজ ও ৬৫.৭৯ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে রংপুর কারমাইকেল কলেজ।
এছাড়া জাতীয় ভিত্তিক সর্বোচ্চ স্কোর অর্জনকারী সরকারি কলেজের মধ্যে সেরা অবস্থানে আছে রাজশাহী কলেজ। যার রেটিং পয়েন্ট ৭২.৯৬। অন্যদিকে ৬১.৮৪ পয়েন্ট নিয়ে সেরা বেসরকারি কলেজের মধ্যে সেরা হয়েছে ঢাকা কমার্স কলেজ। ৫৯.১০ পয়েন্ট নিয়ে সেরা মহিলা কলেজের গৌরব অর্জন করেছে ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজ। এছাড়াও ৮টি আঞ্চলিক পর্যায়ে ৬৮টি সেরা কলেজ নির্বাচন করা হয়েছে।
রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্রেই কলেজটির অবস্থান। কলেজের প্রধান ফটক পেরুতেই চোখে পড়বে দৃষ্টিনন্দন গাঢ় লাল দালান। পরতে পরতে ইতিহাস আর ঐতিহ্য ধারণ করছে রাজশাহী কলেজ। শতবর্ষী এ কলেজের প্রতিষ্ঠা ১৮৭৩ সালে। রয়েছে ঐতিহাসিক বেশ কিছু স্থাপনাও।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রাচীন বাউলিয়া ইংলিশ স্কুল ও কলেজিয়েট স্কুলের হাত ধরেই আজকের রাজশাহী কলেজের যাত্রা। প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় ১৮৭৮ সালে প্রথম গ্রেড মর্যাদা পায় কলেজটি। রাজশাহী কলেজ নামকরণ তখনকারই। উত্তরবঙ্গের প্রথম কলেজ হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর ওই বছরই চালু হয় বিএ কোর্স।
এরপর ১৮৮১ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৮৮৩ সালে যোগ হয় বিএল কোর্স। যদিও ১৯০৯ সালে মাস্টার্স কোর্স ও বিএল কোর্সের অধিভুক্তি বাতিল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও অধিভুক্ত হয়।
এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রি প্রদান করছে রাজশাহী কলেজ। চালু আছে উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমও। তবে শিক্ষার্থী নথিভুক্তি বন্ধ হওয়ায় ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বন্ধ ছিল এ কার্যক্রম। মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা রাজশাহী কলেজ এখন পরিণত হয়েছে দেশের সেরা বিদ্যাপীঠে।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক হবিবুর রহমান বলেন, বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ রাজশাহী কলেজ। বিশেষ করে ভবনগুলো এনে দিয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। কলেজের ঐতিহাসিক ভবনের কথা উঠতেই চলে আসে প্রশাসনিক ভবনের নাম। ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত হয় এ ভবন। এটি ব্রিটিশ ভারতীয় উপনৈবশিক স্থাপত্যের অন্যতম নির্দশন।
ঐতিহ্যের এ ভবনটির চূড়ায় একসময় ছিল রোমান পুরাণের জ্ঞান ও চারুশিল্পের ভাস্কর্য প্যালাস-অ্যাথিনি। পরে একই আদলে আরও দুটো ভাস্কর্য হেমন্ত কুমারী ছাত্রাবাসে স্থাপিত হয়। এই চারটি ভাস্কর্যই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার পাক বাহিনীর দোসরদের চাপে অপসারিত হয়।
প্রশাসনিক ভবনটি কলেজের প্রথম নিজস্ব স্থাপত্যের নিদর্শন। এর জন্য ব্যয় হয় ৬০ হাজার ৭০৩ টাকা। পুঠিয়ার মহারাণী শরৎসুন্দরী দেবী ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন এই সুদৃশ্য ইমারত নির্মাণে। মহারাণী কলেজের সীমানা প্রাচীর ও রেলিং নির্মাণেও অর্থ প্রদান করেছিলেন। তবে ১৯৩৩-৩৪ শিক্ষাবর্ষের প্রসপেকটাসে ভবন নির্মাণ ব্যয় মোট ৬১ হাজার ৭০৩ টাকার কথা উল্লেখ আছে।
জানা গেছে, ভবনটির নির্মাণ শেষে বাউলিয়া হাইস্কুল থেকে রাজশাহী কলেজের ক্লাসসমূহ এই নবনির্মিত ভবনে স্থানান্তরিত হয়। অনেকে ধারণা করেন, এই নতুন ভবনে ক্লাস শুরু হলে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর ক্লাসসমূহ চালুর বিষয় অনুমোদিত হয়।
প্রশাসন ভবনের সামনেই লোকজ বাংলার দেখা মেলে ‘রাজশাহীর চোখ’ টেরাকোটায়। আরেক টেরাকোটা ‘রক্তে ভেজা বর্ণমালা’ নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে দেশের প্রথম শহীদ মিনার। এ ভবনের পেছনে গাঁদা, ডালিয়া, জিনিয়া, ক্যালেন্ডুলার সৌরভে ভরে ওঠে ক্যাম্পাস।
শহীদ মিনার পেরিয়ে বামে বাঁক নিলেই চোখে পড়বে প্রশাসন ভবনের আদলেই গড়া আরেক ঐতিহাসিক ভবন। ভবটির সিঁড়ির উপরে সাদার উপরে কালো হরফে লেখা ‘হাজী মোহম্মাদ মহসিন’। এ ভবনের নামকরণ করা হয়েছে প্রখ্যাত এই দানবিরের নামেই। ১৮৮৮ সালে নির্মিত হয় এ ভবন। তখন হাজী মুহম্মদ মহসীন এটির নির্মাণে আর্থিক অনুদান দেন। তৎকালীন কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত মাদ্রাসা ভবন হিসেবে ব্যবহৃত এটি। পরে মাদ্রাসা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পর এ ভবনটি কলেজরই ভবন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
ভবনটির সামনের রাস্তার ওপারে পুকুর। ভবনের সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ১০১ নম্বর কক্ষ। এটি বর্তমানে গ্যালারি কক্ষ নামেই পরিচিত। সভা-সেমিনার, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজন হচ্ছে এ কক্ষে। ভবনের ১০২ নম্বর কক্ষটি রাজশাহী কলেজ নাট্য সংসদের দফতর। পাশের ১০৩ নম্বর কক্ষটি রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির দফতর। ভবনের ১০৯ ও ১১০ নম্বর কক্ষে রোভার স্কাউটের দফতর। এছাড়া ১০৭ ও ১০৮ নম্বর কক্ষে ব্যস্ত সময় কাটে বরেন্দ্র থিয়েটার এবং রাজশাহী কলেজ সংগীত চর্চা কেন্দ্রের কর্মীদের। তারা সবাই রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী। কলেজের সুবিশাল মাঠের একেবারেই দক্ষিণে আছে অধ্যক্ষের দোতলা বাসভবন।
এই ভবনটিতে উপ-মহাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদগণ বসবাস করে গেছেন। কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষও এখানেই বসবাস করছেন। এটিও নির্মিত হয়েছে ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলীতে।
কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান জানান, রাজশাহী কলেজ এ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক। তাই কলেজের ইতিহাস জানতেও শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি শিক্ষার্থীদের মাঝে থাকবেই। খুব বেশি হলে ইতিহাসের শিক্ষার্থী হিসেবে জানানো হয়েছে ভবটির নির্মাণ সাল ও কারা নির্মাণ করেছিলেন।
রাজশাহী কলেজের মাস্টার্সের পরীক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, র্যাংকিংয়ে রাজশাহী কলেজ তৃতীয় বারের মতো দেশসেরা হওয়ায় তিনি খুব আনন্দিত। সেরা কলেজে পড়তে পেরে তিনি গৌরববোধ করছেন। শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, মনিটরিং, নিয়মিত কাস ও পরীক্ষা নেওয়া এবং সর্বোপরি কলেজের শিক্ষাবান্ধব পরিবেশের জন্য কলেজটি সেরা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ হবিবুর রহমান বলেন, এই গৌরব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় অর্জন। ৪৭ পূর্ব ও পরে থেকে অদ্যাবধি এ পর্যন্ত যতজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী এই কলেজে ছিলেন তাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই অর্জন। বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার প্রচেষ্টায় দেশ সেরার খেতাব ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। এ সফলতার জন্য আগামী শনিবার কলেজের ছুটি শেষ হলে তারা উৎসবের আয়োজন করবেন বলেও জানান অধ্যক্ষ।
রাজশাহী শহরে পদ্মা নদীর ধারে ৩৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী কলেজ। পশ্চিম বঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য স্যার যদুনাথ সরকার, বৈজ্ঞানিক প্রথায় ইতিহাস চর্চার পথিকৃত অক্ষয় কুমার মৈত্র, সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া, শিক্ষানুরাগী মাদার বখশ, জাতীয় চার নেতার একজন এএইচএম কামারুজ্জামানের মতো বরেণ্য ব্যক্তি ছিলেন এ কলেজের ছাত্র।