কুষ্টিয়ার খামারিরা গরু বিক্রি নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে কোরবানি ঈদ উপলক্ষে এবার গরু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কুষ্টিয়ার খামারিরা। কোরবানির ঈদ যতই এগিয়ে আসছে, ততই তাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে লাভের আশা তো দূরের কথা বাজারে গরু তুলে তা বিক্রি করে আসল তুলতে পারবেন কি-না তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন খামারিরা।
দেশে মাংসের চাহিদা মেটাতে বড় ভূমিকা রেখে আসছেন কুষ্টিয়া অঞ্চলের খামারি ও কৃষকরা। গরুর পাশাপাশি বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের বিখ্যাত ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের কদর অনেক বেশি। এবার কোরবানির ঈদ টার্গেট করে জেলার ১৮ হাজার খামারি পালন করেছেন এক লাখেরও বেশি গরু। এছাড়া প্রায় ৬০ হাজার ছাগল পালন করেছেন খামারিরা। করোনার কারণে এবার প্রায় ৫০ ভাগ পশু অবিক্রীত থাকতে পারে বলে জেলার খামারি ও কৃষকরা আশঙ্কা করছেন।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার যদুবয়বা ইউনিয়নের জোতমোড়া গ্রামের খামারি আব্দুল মালেক। সারা বছর বাড়িতে কমবেশি গরু পালন করেন। তবে কোরবানির ঈদ সামনে আসলে লাভের আশায় বাড়িতে গরুর সংখ্যা বাড়ান। এবারও তার খামারে ছোটবড় মিলিয়ে ১২টি গরু রয়েছে। দিন-রাত গরু পরিচর্যায় সময় পার করছেন। তবে ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই তার দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
খামারি আব্দুল মালেক আরো জানান, গত বছর গরু বিক্রি করে মোটামুটি লাভ হয়েছিল। এবারও গরু পালছি। করোনার কারণে এবার লাভ তো দূরে থাক আসল তুলতে পারলেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। গোখাদ্যের যে দাম বেড়েছে তাতে এবার লোকসান হবে বলে মনে হচ্ছে। অন্য বছর আগেই ব্যাপারীরা বাড়ি আসতো। এবার কেউ আসছে না। দু-একজন আসলেও দাম বলছেন অনেক কম।
করোনা পরিস্থিতির কারণে লাভ কম হলেও অনেক খামারি স্থানীয় বাজারে আগেই গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন। যারা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের অন্য জেলায় গরু বিক্রি করেন তারা অপেক্ষা করছেন পরিস্থিতি বোঝার।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্র জানায়, গত বছর জেলায় ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৯০ হাজার গরু পালন হয়েছিল। খামারিরা ভালোই লাভ পেয়েছিলেন। এবার জেলায় প্রায় এক লাখের কাছাকাছি গরু পালন করছেন খামারিরা। গতবারের তুলনায় এবার গরুর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার বেশি।
উপজেলার সদকী ইউনিয়নের দরবেশপুর গ্রামের খামার মালিক সোহেল রানা বলেন, গত বছর সাত লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এতো টাকা বিনিয়োগ করে যদি ভালো দাম না পাই তাহলে দুঃখের সীমা থাকবে না। করোনার কারণে গরু বাজারে নিয়ে বিক্রি করা এবার কঠিন হবে। তাই বাড়ি থেকে বা স্থানীয়ভাবে কম লাভ হলেও গরু ছেড়ে দেবেন বলে জানান। তার খামারে ৫টি বড় গরু রয়েছে।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আলামপুর বালিয়াপাড়াসহ কয়েকটি উপজেলায় বড় গরুর হাট বসে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে হাটগুলো বসছে। বাজারে প্রচুর গরু উঠছে। তবুও গতবারের তুলনায় অনেক কম। বিশেষ করে বড় গরুর চাহিদা এবার নেই বললেই চলে। মাঝারি ও ছোট সাইজের গরু বিক্রি বেশি হচ্ছে বলে জানান ব্যাপারী সিরাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, অন্যান্য বছর আমরা চাহিদা মতো গরু আগে থেকে কিনে রাখতাম। এবার গরু কিনছি না। দু-একজন আছেন যারা কিছু অর্ডারের গরু কিনছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ আছেন যারা আগেই গরু কিনে রাখতেন। এবার তারাও খুব একটা অর্ডার দিচ্ছেন না। গত বছরের তুলনায় এবার চাহিদা অনেক কম।
আজাহার আলী নামে এক গরু ব্যবসায়ী বলেন, গরুর বাজার কম। কোরবানির আগে দাম বাড়বে বলে মনে হয় না। মানুষের হাতে টাকা নেই। কোরবানির সংখ্যা এবার কম হবে। বেশির ভাগ প্রান্তিক খামারি এবার লোকসানে পড়বেন। অনেকেই গরু বিক্রি করতে পারবেন না। যারা বিক্রি করতে পারবেন তারাও লাভ পাবেন কম।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার খাজানগর এলাকার বড় খামার মালিক হাজি ওমর ফারুক। আলামপুর ইউনিয়নের স্বর্গপুর এলাকায় তার খামারটির অবস্থান। সমন্বিত এ খামারে এবার তার ৩৫টি গরু রয়েছে। তবে এবার গরু বিক্রি নিয়ে তার দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
সদর উপজেলার আরেক বড় খামারি উজানগ্রাম ইউনিয়নের সোনাইডাঙ্গা গ্রামের শরিফ হোসেন। তার খামারে ছোটবড় মিলিয়ে ৬০টি গরু রয়েছে। এ গরুর অর্ধেক বিক্রি করা নিয়ে তার দুশ্চিন্তা। লাভ নিয়ে ভাবছেন না। গরু বিক্রি করতে পারলেই তিনি খুশি। কারণ খামারে গরু থেকে গেলে প্রতিদিন তার পেছনে ব্যয় আছে। তাতে লোকসান আরও বাড়বে। খামার খালি করা নিয়েই ভাবছেন তিনি।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবার ঈদের দু-এক মাস আগে থেকেই জেলার হাটে হাটে ঘুরে ব্যাপারীরা গরু কিনে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন হাটে তুলতেন। এবার সেই সংখ্যা অনেক কম। জেলায় বড় পশুর হাট রয়েছে ১২টি। এসব হাট ছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরও ছোট ছোট হাট-বাজারে বিক্রির জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার গরু-ছাগল নিয়ে আসছেন খামারিরা। কিন্তু কেনাবেচা একদম কম। ঈদুল আজহার আর মাত্র ২০-২২ দিন বাকি থাকলেও এবার বাইরের ব্যাপারীদের তেমন একটা দেখা মিলছে না।
কুষ্টিয়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, জেলায় এবার প্রচুর গরু পালন করেছেন খামারিরা। ঈদ এগিয়ে আসায় তাদের দুশ্চিন্তা বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় জেলার খামার মালিকরা ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে গরু নিয়ে লাভ করতেন। তারা এবার ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। কারণ জীবন আগে পরে জীবিকা। এ অবস্থায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে গরুর বাজার। স্থানীয় বাজারে কেনাবেচা হলেও বাইরে থেকে ব্যাপারীরা এবার আসছেন না দেখে চিন্তা বেড়েছে খামারিদের। তিনি আরও বলেন, আমরা খামারিদের মনোবল বাড়াতে কাজ করছি। তাদের নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে আসছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *