দেড় যুগ আগের স্মৃতি ফিরল

অনলাইন ডেস্ক: ভোর রাতে উঠেছিলেন খেলা দেখতে? তাহলে তো কী হয়েছে, আপনি দেখেছেনই। না উঠে থাকলে অবশ্য ওয়েলিংটন টেস্টের সমাপ্তিটা আপনাকে হাইলাইটস বা লেখা পড়েই জানতে হবে। অ্যালার্ম আপনার ঘুম ভাঙিয়ে না থাকলে ওয়েলিংটন টেস্ট আপনার পাওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশ সময় ভোর ৬টার একটু পরেই যে শেষ হয়ে গেছে সব।

কথাটা অবশ্য বাংলাদেশের পাঠকদের জন্যই শুধু প্রযোজ্য। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রথম আলোর পাঠকদের উদ্দেশে নির্দিষ্ট একটা কিছু বলা কঠিন। একেক টাইম জোনে একেকজন। নিউজিল্যান্ডে খেলা শুরুর সময়টা বাংলাদেশে ভোর রাত হলেও তাঁদের কারও জন্যও হয়তো সেটি দুপুর, বিকেল, কারও হয়তো সন্ধ্যাও। একটু সুবিধা তো হয়েছেই এতে। বাংলাদেশে যাঁরা খেলা দেখতে উঠেছেন, তাঁদের তুলনায় খেলা দেখার কষ্টটাও একটু হলেও কম হয়েছে। যা খেলা হলো, তা দেখার কষ্টটা অবশ্য সর্বজনীন। বিশ্বের কোন দেশ থেকে তা দেখছেন, তাতে কিছু আসে যাচ্ছে না।

হ্যামিল্টনে প্রথম টেস্টেও ইনিংস ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ওয়েলিংটন টেস্টের সঙ্গে সেটির তুলনা চলে না। সেখানে দ্বিতীয় ইনিংসে একটু হলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সৌম্য সরকার ও মাহমুদউল্লাহ। চতুর্থ দিনেই খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এক টেস্টে তিনটি সেঞ্চুরি কিছুটা হলেও সান্ত্বণা হয়ে এসেছিল।

কিন্তু এখানে? এখানে কীভাবে এমন অসহায় আত্মসমর্পণ! বৃষ্টির কারণে প্রথম দুদিন একটা বলও হয়নি। টসই হয়েছে তৃতীয় দিন সকালে। তারপরও বাংলাদেশ শুধু হারতেই সক্ষম হয়নি, সেই হারও ইনিংস ব্যবধানে। সেটিও পঞ্চম দিনের লাঞ্চের মধ্যেই।

পঞ্চম দিন অবশ্য কাগজে-কলমে। আসলে তো এই টেস্টের তৃতীয় দিন! সেটিরও প্রথম দিনে পুরো খেলা হয়নি। ১০৫ ওভার খেলা হওয়ার কথা ছিল, বৃষ্টির কারণে হতে পেরেছে ৭২.৪ ওভার। আজ লাঞ্চের মধ্যে খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বললে অবশ্য ছোট্ট একটা টীকা লাগছে। লাঞ্চের নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশের ৮ উইকেট পড়ে গেছে বলে ১৫ মিনিট সময় বাড়িয়ে দিয়েছিলেন দুই আম্পায়ার। এই সময়ের মধ্যেই যদি খেলা শেষ হয়ে যায়, তাহলে লাঞ্চ-টাঞ্চ করে আবারও মাঠে নামার ঝামেলায় যাওয়ার কী দরকার! সেই ঝামেলায় যেতেও হয়নি। বাড়তি সেই ১৫ মিনিট শেষ হওয়ার আগেই বাকি দুই উইকেট হারিয়ে অলআউট বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসের চেয়েও যেটি সংক্ষিপ্ত। প্রথম ইনিংসে ৬১ ওভার ব্যাটিং করেছিল বাংলাদেশ, দ্বিতীয় ইনিংসে এর চেয়ে ৫ ওভার আগেই সব শেষ!

প্রথম ইনিংসে বলতে গেলে একাই লড়াই করেছিলেন তামিম ইকবাল। দ্বিতীয় ইনিংসে যা করলেন মাহমুদউল্লাহ। সঙ্গী পেলে হয়তো ইনিংস পরাজয়টা এড়াতে পারতেন। সেটি যে পেলেনই না। সৌম্য সরকার দর্শনীয় কিছু শট খেলার পর বলতে গেলে স্লিপকে ক্যাচিং প্র্যাকটিস করিয়ে ফিরে আসার পর নেমে পেয়েছিলেন মোহাম্মদ মিঠুনকে। খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়। ৪০ রান যোগ হওয়ার পরই ভেঙে গেল সেই জুটি।

প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ড সফরে আসা মিঠুন অচেনা উইকেট, এই প্রথম পরিচয় হওয়া শরীর ধেয়ে আসা বোলিংয়ের বিপক্ষে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গেছেন। কিন্তু ইচ্ছা আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় আর কতক্ষণ এসব সামলানো যায়! ওয়াগনারের শর্ট বোলিংয়ে অতিষ্ট হয়ে নিজের মতো করে সেটি সামলানোর একটা পথ বের করে নিয়েছিলেন। কিছু বল গায়ে নিয়েছেন, কিছু ইম্প্রোভাইজ করে মেরেছেন। ওয়াগনারকে মারতে গিয়েই ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ হয়ে গেছেন টিম সাউথির হাতে। ১৬২ মিনিটে ১০৫ রান করে এই ৪৭ রান তাঁকে নিশ্চয়ই অনেক কিছু শিখিয়েছে। কিন্তু এখানে যে ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার চেয়ে বর্তমানে মান বাঁচানোটা বেশি জরুরি ছিল।

লিটন দাস মাত্র সাত বল টিকতে পারায় সেটি যে হচ্ছে না, তা নিশ্চিত হয়ে যায়। ওয়াগনার এই সিরিজে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আতঙ্কের নাম নিল ওয়াগনার। যে যাঁর মতো তাঁকে সামলানোর পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন ব্যাটসম্যানরা। লিটন বোধ হয় ঠিক করে নেমেছিলেন, পাল্টা আক্রমণ ছাড়া বাঁচার কোনো পথ নেই। তবে সে জন্য আরেকটু সময় নিলে হয়তো ভালো করতেন। নামার পর সপ্তম বলেই ওয়াগনারকে পুল করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে দিলেন ফাইন লেগে।

এরপর বাকি থাকেন শুধু বোলাররা। যাঁরা মিলে এই মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেটে দীর্ঘতম ব্যাটিং লেজের জন্ম দিয়েছেন। আজ অবশ্য মোস্তাফিজুর নিজেকে একটু ব্যতিক্রম বলে দাবি করতে পারেন। এর আগে টেস্টে তাঁর সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল ১০। সেটিকে ছাড়িয়ে গেলেন। ‘যা আছে কপালে’ বলে ব্যাট চালিয়ে মেরে দিলেন দুটি ছক্বাও। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ চালিয়ে যাওয়া যায়! ট্রেন্ট বোল্ট তাঁর ভাবসাব দেখে একটা বল ওপরে করলেন। মোস্তাফিজ সেটিকেও উড়িয়ে মারতে গিয়ে ব্যাট ঘোরালেন বাতাসে। বোল্ড!

তখনই আম্পায়ারদের পনের মিনিট সময় বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। ৬৭ রান করে মাহমুদউল্লাহ নবম ব্যাটসম্যান হিসাবে আউট হওয়ার পর আর মাত্র দুটি বলই লাগল ইনিংস শেষ হতে। যেটি আসলে টেস্টেরও শেষ! যেটি ফিরিয়ে আনল প্রায় দেড় যুগের আগের স্মৃতিও। ২০০১ সালে হ্যামিল্টনে খেলা নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম টেস্টটিও যেন ফিরে এল ওয়েলিংটনেও। সেবার হ্যামিল্টনেও বৃষ্টিতে প্রথম দুদিন ভেসে যাওয়ার টস হয়েছিল তৃতীয় দিনে। সামান্য পার্থক্য বলতে, পঞ্চম দিন সকালে ৫৫ মিনিটের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের বাকি ৬ উইকেট। এখানে বাকি ৭ উইকেট পড়তে আড়াই ঘণ্টার একটু বেশি লাগল। এটাকে যদি উন্নতি বলেন, বলতে পারেন। তবে সাদা চোখে তো মনে হচ্ছে, সোয়া ১৭ বছর আগে-পরে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে আশ্চর্য ধারাবাহিকতা!

ক্রাইস্টচার্চে তৃতীয় টেস্টটা কি না খেললে হয় না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *