অনলাইন ডেস্ক : রক্তের তিনটি জটিল রোগের নাম থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া ও ব্লাড ক্যান্সার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এসব ব্লাড ডিজিজ বা রক্তরোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে।তবে সব ধরনের রক্তরোগের সমন্বিত চিকিৎসা প্রদানে দেশে সরকারি পর্যায়ে নেই কোনো বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এসব রোগ ও রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
রক্তরোগ বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তরোগ। রক্তের মধ্যে যে তিনটি উপাদান থাকে তার অন্যতম হল লোহিত রক্তকণিকা। এর ভেতরেই থাকে হিমোগ্লোবিন, যা রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ করে কোষগুলোকে সক্রিয় রাখে। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণ লোহিত রক্তকণা উৎপাদন হয় না। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা-মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে বংশানুক্রমে এ রোগটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়।
থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ১৪ জনে একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক। প্রতিবছর প্রায় ১০৪০ শিশু বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর এবং প্রায় ৬৪৪৩ শিশু হিমোগ্লোবিন ই-বিটা থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বেঁচে থাকতে এই রোগীদের নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হয়। যা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল অন্যদিকে কষ্টসাধ্যও বটে।
রক্তের আরেকটি বংশানুক্রমিক জিনগত রোগের নাম হিমোফিলিয়া। এ রোগে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে সমস্যা হয় তাই শরীরে কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত বন্ধ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি দশ হাজার জনে একজন হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ১৬ হাজার হিমোফিলিয়া রোগী রয়েছে। রক্তে জমাট বাঁধার উপাদান বা ফ্যাক্টর জন্মগতভাবে কম থাকার কারণে হিমোফিলিয়া রোগটি হয়ে থাকে। এ রোগটি সাধারণত পুরুষের ক্ষেত্রেই লক্ষণীয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্তে ফ্যাক্টর-৮-এর ঘাটতির কারণে হিমোফিলিয়া-এ এবং ফ্যাক্টর-৯-এর অভাবে হিমোফিলিয়া-বি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। হিমোফিলিয়া হলে রোগীর খুব বেশি রক্তপাত হয়। মহিলাদের মাসিকের সময় অনেক দিন ধরে রক্ত ঝরা, সময়ে সময়ে নাক বা দাঁত দিয়ে রক্ত বের হওয়া, দাঁতের অপারেশনের পর প্রচুর রক্তপাত হওয়া এবং প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া এসবই হিমোফিলিয়া রোগের কারণ। সাধারণত দুই ধরনের হিমোফিলিয়া রোগী দেখা যায়, হিমোফেলিয়া-এ এবং হিমোফিলিয়া-বি। চিকিৎসকদের মতে, ৮৫ শতাংশ রোগীর হিমোফেলিয়া-এ এবং ১৫ শতাংশ রোগীর হিমোফেলিয়া-বি হয়ে থাকে। হিমোফিলিয়া একটি অনিরাময়যোগ্য রোগ।তবে আক্রান্তের প্রথম দায়িত্বই হচ্ছে সচেতনতার সঙ্গে চলাফেরা করা। যেন কোনোরূপ আঘাতে রক্তক্ষরণ না ঘটে। এ রোগীর রক্তক্ষরণ বন্ধে প্রধান ব্যবস্থা রক্তসঞ্চালন। রক্ত থেকে তৈরি ‘ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা’ এ রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সক্ষম। তবে ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা তৈরিতে অনেক রক্তের ও অনেক সময়ের প্রয়োজন। এ ছাড়া এ প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যয়বহুল। দরিদ্র অসহায় রোগীদের ক্ষেত্রে প্লাজমা তৈরি ও সংগ্রহ এক প্রকার দুঃসাধ্য ব্যাপার।
রক্তের আরেকটি মরণব্যাধির নাম রক্তকোষের ক্যান্সার বা ব্লাড ক্যান্সার। দিন দিন যে হারে ব্লাড ক্যান্সার বাড়ছে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বহুলাংশে বেড়ে যাবে।
ঠিক কী কারণে ব্লাড ক্যান্সার হয়, সে বিষয়টি এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে রেডিয়েশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল বা কারখানায় ব্যবহৃত রাসায়নিক, পেস্টিসাইড বা কীটনাশক, ভেজাল খাবার ও খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার, হেয়ার ডাই ও কিছু প্রসাধনীর ব্যবহার, লুব্রিকেন্টস, বার্নিশ, কেমোথেরাপি ব্যবহারের ইতিহাস ও কিছু জেনেটিক অসুখ থাকলে ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া মূলত দু’ধরনের। অ্যাকিউট লিউকেমিয়া ও ক্রনিক লিউকেমিয়া। অ্যাকিউট লিউকেমিয়া খুবই মারাত্মক হয়। দ্রুত চিকিৎসা না নিলে রোগী বেশি দিন বাঁচতে পারে না। অ্যাকিউট লিউকেমিয়া আবার দু’ধরনের, অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএলএল এবং অ্যাকিউট মায়েলোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএমএল। যে প্রকারেরই অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএলএল হোক না কেন, চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি।
শুধু কেমোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করলে দুই থেকে আড়াই বছর চিকিৎসা নিতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করতে হয়। ক্রনিক লিউকেমিয়ারও প্রকারভেদে চিকিৎসার ধরন ভিন্ন ভিন্ন। ক্রনিক লিউকেমিয়ার রোগী সঠিক চিকিৎসা নিয়ে অনেক দিন ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে।
রক্তরোগের উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসা প্রদানে ল্যাব ওয়ান ফাউন্ডেশন ২০০২ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ল্যাব ফাউন্ডেশনের প্রধান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. সালাহউদ্দিন শাহ গণমাধ্যমকে জানান, অসহায় ও দরিদ্র রোগীদের স্বল্পমূল্যে উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসা প্রদানে এ প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে।
দরিদ্রদের চিকিৎসায় অনুদানের ব্যবস্থা রয়েছে। ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রায় ২৫০০ নিবন্ধিত রোগী আছে। যারা স্বল্পমূল্যে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করছে। তিনি জানান, সব ধরনের রক্তরোগের সমন্বিত চিকিৎসা প্রদানে সম্প্রতি ল্যাব ওয়ান রিসার্চ ইন্সটিটিউট অব হেমাটোলজি অ্যান্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
তবে এটিকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে আরও অনেক টাকার প্রয়োজন। টাকা সংগ্রহে আগামী তিন বছরের মধ্যে তিন লাখ মাটির ব্যাংক, তিন লাখ ইন্টারন্যাশনাল মেম্বার এবং তিন লাখ ন্যাশনাল মেম্বার সংগ্রহের কাজ চলছে। প্রাপ্ত অর্থ রোগীদের চিকিৎসা, রোগ সম্পর্কে রিসার্চ এবং প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার কাজে ব্যয় করা হবে।