আকাশে কাগজের ছাতা ও ফানুসের মেলা থাইল্যান্ডে

অনলাইন ডেস্ক :

 

১৯৮৩ সাল থেকে প্রতি বছরের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে তিন দিনের এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। থাইল্যান্ডের চাংমাই শহরের বো-সাং গ্রামে প্রথম ছাতা শিল্পীদের আবির্ভাব ও দুই প্রজন্ম ধরে তারা এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

 

থাইল্যান্ডের স্থানীয় কাগজ ‘সা’ দিয়ে তৈরি হয় ছাতা, ফানুস, হাতপাখা থেকে শুরু করে অনেক কিছু। এক সন্ন্যাসীর হাত ধরে মিয়ানমার থেকে এই শিল্প এসে স্থান করে নেয় বো-সাং গ্রামে। ফলে বো-সাং তার নিজের নামের বদলে পর্যটকদের কাছে ছাতার গ্রাম হিসেবেই বেশি পরিচিত।

বো-সাং গ্রামের ছাতাশিল্পীরা তুঁত গাছের বাকল দিয়ে স্থানীয়ভাবে ‘সা’ নামের এক ধরনের কাগজ বানান। এই গ্রামের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হলো ‘সা কাগজ।’ প্রায় শতাব্দী ধরে তারা স্থানীয় প্রযুক্তির সাহায্যে এই কাগজ বানিয়ে আসছেন। ‘সা’ কাগজ দিয়ে ছাতা ছাড়াও হাতপাখা, ফানুসসহ কাগজের বিভিন্ন কারুকার্যময় সামগ্রী বানান।

 

থাইল্যান্ডে বেশিরভাগ লোক কৃষিজীবী হওয়ায় এই শিল্প জনপ্রিয় হয়ে উঠলে প্রতি বছর শরতে ঘরে ফসল তোলার পর তারা ফানুস উৎসবের আয়োজন করেন। ফলে সা কাগজের বিভিন্ন জিনিস তৈরি নিয়ে পুরো থাইল্যান্ড জুড়ে উৎসব হয়।

 

কাগজ ও কাপড়ের প্রধানত দুই ধরনের ছাতা তৈরি হয় এখানে। ছাতার মূল ফ্রেম তৈরি হয় বাঁশের চিকন টুকরো দিয়ে। অন্যদিকে, কাগজের মণ্ড পাতলা একটি তারজালিতে করে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। বাঁশের টুকরোগুলো বেঁধে ছাতার মূল ফ্রেমটি বানানো হয়ে গেলে ফ্রেমের ওপরে কাগজ আঠা দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। আঠা লাগানো শেষ হয়ে গেলে কাগজের বাড়তি অংশ কেটে ফেলা হয়। ছাতার মূল আকৃতি তৈরি হয়ে গেলে আরেক দফা আঠা লাগিয়ে রোদে শুকানো হয়।

 

পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে একরঙা সেই কাগজের ছাতার ওপরে তুলির সাহায্যে বিভিন্ন রং করে দেওয়া হয়। বাঁশের তৈরি পাতলা ফ্রেমের ওপরে ফুলেল মোটিফ দিয়ে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা হয় কাগজের ওপরে। শিল্পী তার মনের মাধুরী মিশিয়ে রঙিন তুলিতে ফুটিয়ে তোলেন একের পর এক ডিজাইন। আঁকা শেষে আরেক দফা রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয় ছাতাগুলো।

 

কাগজের তৈরি ছাতা বলেই রোজকার ব্যবহারের উপযোগিতা নেই সেগুলোতে। অন্যান্য কারুপণ্যের মতোই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাজিয়ে রাখার কাজেই ব্যবহৃত হয় এগুলো। দেশ-বিদেশ থেকে ছাতার সঙ্গে মিশে থাকা গল্পের সন্ধানে পর্যটকরা বো-সাং ঘুরে দেখতে যান। আর ঘুরতে গেলে অবশ্যই ছাতা না নিয়ে ফেরেন না কেউ। ফলে থাইল্যান্ডের পর্যটন শিল্পের একটি বিশাল অংশ জুড়ে আছে এই ছাতাশিল্পীদের অবদান।

 

স্থানীয়ভাবে গ্রীষ্মে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই ছাতাগুলো ব্যবহার করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এক শতাব্দীব্যাপী নিজেরা বানাচ্ছেন বলে প্রবীণ নাগরিকরা এখনো রোদ-বৃষ্টিতে কাগজের ছাতাই ব্যবহার করে থাকেন।

 

‘সা’ কাগজের বিশেষত্ব হচ্ছে, এর ভেতরে থাকা দানাদার অংশ কাগজকে পানি শুষে নিতে বাধা দেয়। বৃষ্টি প্রতিরোধের জন্য অনেক ছাতার কাগজের ওপরে তেলের প্রলেপ দেওয়া হয়। ফলে পানিরোধী হিসেবে বৃষ্টির দিনে ব্যবহারের পরেও দীর্ঘদিন টিকে থাকে এই ছাতাগুলো।

 

বিশ্বজুড়ে চীনা পণ্যের আধিক্য সত্ত্বেও থাইল্যান্ডে চীনা ছাতা পাওয়া যাবে না। দেশি পণ্যের মানের ব্যাপারে এটি স্থানীয় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্ট প্রকাশ। স্থানীয় অর্থনীতিই শক্তিশালী না হলে যে জাতীয় অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারবে না তা থাইল্যান্ডের স্থানীয় জনগণ ও পর্যটনবান্ধব দেশীয় নীতিমালায় সরকারের একত্রিত অবদানের ফল।

 

শৈল্পিক, সুনিপুণ, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এই তিনের অনন্য সম্মিলনে এই কাগজের ছাতা শতাব্দী ধরে টিকে আছে। থাইল্যান্ডের স্থানীয় পরিমণ্ডল ছাপিয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে এই ছাতার গল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *