অনলাইন ডেস্ক : ১৫ বছর বয়সী শাওন রাজধানীর গেন্ডারিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় এই হাইস্কুলের পাশের রাস্তায় দুই পক্ষের মারামারিতে গুরুতর আহত হয় শাওনসহ তিন কিশোর। গতকাল রোববার ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাওন মারা যায়।
২৯ জুন হাজারীবাগ এলাকায় ১৫ বছর বয়সী ইয়াছিন আরাফাত খুন হয়। পুলিশ বলছে, বড়-ছোটর (সিনিয়র–জুনিয়র) দ্বন্দ্বের জেরে শাওন ও ইয়াছিন খুন হয়েছে।
শিশু-কিশোর অপরাধের মামলার বিচার হতো ঢাকার শিশু আদালতে। এই আদালতে ২০১৮ সালের ৩১ নভেম্বর পর্যন্ত চলমান ছিল ১ হাজার ৩৮১টি মামলা। এর মধ্যে খুনের মামলা ৮৬টি। এসব খুন হয়েছে গত ১৫ বছরে। দেড় শতাধিক কিশোরের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেয় পুলিশ। এ বছর ১৯ জানুয়ারির পর থেকে এসব মামলার বিচার চলছে ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত, মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত এবং শিশু আদালতের বিচারিক নিবন্ধন খাতার তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে সব মিলিয়ে ঢাকায় ৯৯ খুনের মামলায় তিন শর বেশি কিশোর জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে গত দেড় বছরেই ঘটেছে ১৩টি খুন। এতে জড়িত অন্তত ১২০ কিশোর। এদের নাম উল্লেখ করে খুনের মামলাও হয়েছে। এদের মধ্যে ২৭ জনকে আদালতের মাধ্যমে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
তিন বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকার শিশু আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন সরকারি কৌঁসুলি শাহাবুদ্দিন মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় বহু খুন, ধর্ষণ, মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে শিশু-কিশোরেরা। তবে বড়-ছোট দ্বন্দ্বের জের ধরেই সবচেয়ে বেশি কিশোর খুন হচ্ছে।
খুনোখুনিতে কেন জড়াচ্ছে কিশোরেরা
ঢাকায় ১৬ বছরে সংঘটিত ৯৯টি খুনের মামলার ৩০টির নথিপত্র পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো। এতে দেখা যায়, ঢাকার উত্তরা, হাজারীবাগ, চকবাজার, বংশালসহ বিভিন্ন এলাকায় কিশোরদের গ্যাং গড়ে উঠেছে। তারা খুন ছাড়াও ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে।
- ঢাকার উত্তরা, হাজারীবাগ, চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় কিশোরদের গ্যাং
- ঢাকায় খুন, ধর্ষণ, মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে শিশু-কিশোরেরা
- বড়-ছোট দ্বন্দ্বের জের ধরেই সবচেয়ে বেশি কিশোর খুন হচ্ছে
- কিশোরদের সঙ্গে সমাজের যে সম্পর্ক থাকা উচিত, তা অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত
- আগে যে সামাজিক ও পারিবারিক অনুশাসন ছিল, তা এখন ভেঙে পড়ছে
বড়–ছোটর দ্বন্দ্বের জের ধরে ঢাকায় সব থেকে বেশি শিশু-কিশোর খুনের ঘটনা ঘটেছে। প্রথম আলোর দেখা নথিপত্র অনুযায়ী, ৩০টি খুনের মধ্যে ১৪টিই ঘটেছে এই দ্বন্দ্বের কারণে। দুই পক্ষই পূর্বপরিচিত। এ ছাড়া প্রেমসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ৬টি খুনের ঘটনায় জড়িয়েছে কিশোরেরা। বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুন হয়েছে ৬টি।
কিশোর খুনের মামলার কাগজপত্র বলছে, খুনের শিকার বেশির ভাগ কিশোরের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছর। এসব খুনের ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।
খুনের শিকার অন্তত ১১টি কিশোরের পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। পরিবারগুলোর বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। আর খুনের ঘটনায় জড়িত কিশোরদের অনেকে নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য।
কিশোরেরা কেন এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞানের অধ্যাপক জিয়া রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে কিশোরদের সঙ্গে সমাজের যে সম্পর্ক থাকা উচিত, তা অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। আগে যে সামাজিক ও পারিবারিক অনুশাসন ছিল, তা এখন ভেঙে পড়ছে। কিশোরদের বড় একটা অংশই এখন ইন্টারনেটে অতিরিক্ত আসক্ত হচ্ছে, ভিডিও গেম খেলছে। পর্নোগ্রাফি দেখছে। সব মিলিয়ে কিশোরদের মনস্তত্ত্বে বড় একটা পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে তারা মারাত্মক সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বড়-ছোট দ্বন্দ্ব
২০১২ সালের ১ নভেম্বর শাকিল (১৮) ভাটারা এলাকায় খুন হন। তদন্ত করে ঢাকার আদালতকে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে জানায়, ঈদুল আজহার আগে শাকিলের সঙ্গে ওই এলাকার এক কিশোরের বড়-ছোট নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়। এর জেরে শাকিল খুন হন।
গত বছরের ১২ এপ্রিল এসএসসি পরীক্ষার্থী রাসেল রনি খুন হয়। এই খুনে জড়িত সন্দেহে আইনের আওতায় এনে পুলিশ আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, রাসেল খিলগাঁও গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার হাইস্কুলে পড়ত। ঘটনার দিন স্থানীয় একটি মাঠে সে ক্রিকেট খেলতে যায়। খেলায় তার দল জেতে। কিন্তু বড়–ছোট নিয়ে দুই পক্ষের কথা-কাটাকাটি হয়। এর জেরে রাসেলকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ অনেক কিশোরের পক্ষে মামলায় লড়েছেন, মিশেছেন তাদের পরিবারের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পারিবারিক বন্ধন আগের মতো নেই। ঢাকার অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের সময় দিতে পারছেন না। অনেক কিশোর মাদকে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোরদের মধ্যে ‘হিরোইজম’ দেখানোর অদ্ভুত মানসিকতা জেঁকে বসেছে।
গ্যাং ও আধিপত্য বিস্তার
৭ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দক্ষিণ পাশে খুন হয় সিজান (১৫)। এ ঘটনায় জড়িত চকবাজার-বংশাল এলাকাকেন্দ্রিক একটি কিশোর গ্যাং। এ ঘটনায় আইনের আওতায় আসা তিন কিশোর এখন কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে। এই হত্যা মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আদালতকে গত মার্চে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, পুরান ঢাকার সুরিটোলা, চানখাঁরপুল ও মালিটোলা এলাকায় সিনিয়র-জুনিয়র গ্রুপ আছে। এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে দুটি গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। এই বিরোধের জের ধরে সিজান খুন হয়।
নিহত সিজানের মামা শাওন হোসেনও প্রথম আলোকে বলেন, বংশাল ও চকবাজার থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং আছে। এলাকায় নানা অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িত।
তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ জোনের উপকমিশনার (ডিসি) ইব্রাহীম খান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, উত্তরায় যেভাবে কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ গড়ে উঠেছে, সেভাবে পুরান ঢাকায় গ্যাং গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। কারণ, এটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।
১৫ বছর বয়সী আরিফ হোসেন কাজ করত পুরান ঢাকার একটি কারখানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনের ফুটপাতে গত ১৫ মার্চ বিকেলে আরিফকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, কিশোর গ্যাংয়ের ছয় সদস্য আরিফকে খুন করে। এরা বেশ কিছুদিন ধরে হাইকোর্ট মাজার এলাকায় ছিনতাই করত।
প্রেমসংক্রান্ত বিরোধ
গত বছরের ১ মার্চ পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় হোলি উৎসব চলাকালে খুন হয় উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী রওনক হোসেন। প্রেমসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে রওনক খুন হয় বলে পুলিশ আদালতকে প্রতিবেদনে জানিয়েছে।
প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর মিরপুরে খুন হন একজন ব্যবসায়ী। পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রীর সঙ্গে এক কিশোরের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর জেরে ওই কিশোর আরও তিন কিশোরকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
মাদকও বড় সমস্যা
শিশু–কিশোরদের মামলার তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত পুলিশ ও আইনজীবীরা বলছেন, খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে আরেকটি কারণ মাদক। অনেক কিশোর মাদক কেনাবেচায় জড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই মাদকসেবী।
ঢাকার শিশু আদালতের হিসাব অনুযায়ী, ১ হাজার ৩৮১টি মামলার মধ্যে মাদকসংক্রান্ত মামলা ১৪৬টি। এসব মামলায় কিশোরদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া চুরির ৬৮টি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে কিশোরদের। ৬১টি ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা এবং যৌন নিপীড়নের মামলায় অভিযুক্ত শতাধিক কিশোর।
আইনের আওতায় আসা শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। এই অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সুমন মধু প্রথম আলোকে বলেন, মাদক, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে শিশু-কিশোরেরা। দিন দিন মামলাও অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন মামলায় ১৮ বছরের কম বয়সীদের আদালতের মাধ্যমে ঢাকার অদূরে গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মাদক, খুন, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ নানা মামলায় ৭২৪টি শিশু কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আছে। এই হিসাব গত ৩০ এপ্রিলের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রে থাকা ৭২৪ শিশু-কিশোরের মধ্যে ২৭৭ জনই মাদক মামলার। মাদকের পর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় জড়িত কিশোরের সংখ্যাই বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেহাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে আইনের শাসনের ঘাটতি থাকায় কিশোরেরা খুন, ধর্ষণ, মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বড়রা কিশোরদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করছেন। কিশোর অপরাধ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনীতিবিদ—সর্বোপরি সরকারকে আরও সচেতন হতে হবে। কিশোরদের জীবনের লক্ষ্য কী, তা ভালোভাবে শেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।