অনলাইন ডেস্ক :
প্রতিবেশী দেশ ভারতে সংক্রমণের তুঙ্গে থাকা করোনাভাইরাসের ‘ভারতীয় ভেরিয়েন্ট’ শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশেও। গত ৮ মে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বাংলাদেশে এটি শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ভারত থেকে আসা মানুষের মধ্য থেকে আটজনের নমুনা পরীক্ষা করে ছয়জনের মধ্যে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে দুটিতে শতভাগ এবং বাকি চারটিতে ভারতীয় ভেরিয়েন্টের অংশ বিশেষ উপস্থিতি রয়েছে। আক্রান্তরা সবাই বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।
বেশ কিছুদিন ধরে সরকার ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্ট সম্পর্কে সতর্ক করে আসছিল। বলা হচ্ছিল এই ভেরিয়েন্ট দেশে ঢুকলে বিপদ অনেক বেশি হবে। বলতে বলতেই ভারতীয় ভেরিয়েন্ট এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে দেশে। তাতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গত কয়েক দিনে যেভাবে ঈদের কেনাকাটা করতে মার্কেটে মানুষ ভিড় করছে, গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পথে পথে ঢল নেমেছে লাখো মানুষের, তাতে এই ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে গোটা দেশকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভেরিয়েন্টটি অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একজন থেকে ৪০০ জন পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে। দেশে এই ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তখন সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে’।
সংক্রমণ ঠেকাতে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসারে এ বছর ঈদে যে যেখানে আছেন সেখানেই ঈদ করুন। এমনকি বর্তমান পরিস্থিতিতে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যাওয়াও ঠিক হবে না। সবাইকে দ্রুত ভ্যাকসিন নেওয়া, প্রয়োজনে দুটি মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ সবধরনের স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাভাইরাসের ভেরিয়েন্ট নির্ধারণে জেনোম সিকোয়েন্সিং করা হচ্ছে, এন্টিবডি পরীক্ষার ব্যবস্থাও আছে।
ভাইরাসের জেনেটিক মিউটেশনের কারণে বিভিন্ন ধরনের ভেরিয়েন্টের উৎপত্তি হয়। এর মধ্যে কোনো কোনো ভেরিয়েন্ট সংক্রমণ, ভোগান্তি, জটিলতা ও মৃত্যুহারের বিবেচনায় অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ভেরিয়েন্টগুলো বিভিন্ন মাত্রার শক্তিশালী হলেও ভ্যাকসিন অবশ্যই নিতে হবে। কারণ ভ্যাকসিন নিলে সবধরনের ভেরিয়েন্ট থেকে কমবেশি রক্ষা পাওয়া যাবে।
আশার কথা ভারতীয় ভেরিয়েন্ট আমরা শুরুতেই শনাক্ত করতে পেরেছি এবং দ্রুততর সময়ের মধ্যেই সরকার তা মানুষকে জানিয়ে দিতে পেরেছে। ফলে এই ভেরিয়েন্টের ছড়িয়ে পড়া রুখে দেওয়া সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট যদি ছড়ানোর পথ আমরা বন্ধ রাখতে পারি, তবে ওই ভেরিয়েন্ট আমাদের তেমন কিছু করতে পারবে না, যেমনটা হয়েছে যুক্তরাজ্যের ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রে। আমরা দেশে যুক্তরাজ্যের ভেরিয়েন্ট আসার পরপরই তা আটকে দিতে পেরেছি বলে এখানে তা ছড়াতে পারেনি।
আইইডিসিআর এর পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরীন বলেন, এখনো ভারতীয় যে ভেরিয়েন্ট দেশে শনাক্ত হয়েছে, সেটা দুজন ছাড়া অন্যদের মধ্যে পাওয়া যায়নি। ফলে এটা যে ছড়িয়েছে তা এখনো বলতে পারছি না। তবে সবারই সতর্ক থাকা জরুরি। বিশেষ করে ঠিকভাবে মাস্ক পরা, জনসমাগম এগিয়ে চলা ও টিকা নেওয়ার নির্দেশনা মেনে চললে যে ভেরিয়েন্টই হোক, ছড়ানোর সুযোগ থাকবে না।
তবে কেবল ভারতীয় ভেরিয়েন্টের দিকে তাকিয়ে থাকলে ভুল হবে। বরং গত কয়েক দিন ধরে যেভাবে ঢাকাসহ সারা দেশে মানুষের অবাধ বিচরণ চলছে, তাতে দেশে আগে থেকেই ঘাঁটি গেড়ে থাকা ভেরিয়েন্টও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। যেকোনো মূল্যেই হোক মানুষের ঢল বা করোনাভাইরাসের বিস্তারের পথ বন্ধ না করলে বিপদ আসবেই।
এদিকে দেশে ঈদ মার্কেটিং ও বাড়িমুখে মানুষের ভিড় দেখে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, যা দেখছি- খুবই দুঃখজনক। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ঈদের পড়ে সংক্রমণ, মৃত্যু ঠেকানো বা হাসপাতালে রোগীর চাপ সামাল দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। মানবিক বা অর্থনৈতিক কারণে সরকার শর্তসাপেক্ষে যেটুকু শিথিল-সুযোগ দিয়েছে সেগুলোর চরম অপব্যবহার ঘটছে। দোকান মালিক কিংবা পরিবহন খাতের লোকজন যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কিংবা শর্ত মেনে দোকান চালুর অনুমতি নিয়েছেন সরকারের কাছ থেকে, কিংবা শহরের মধ্যে পরিবহন চালাচ্ছেন সেগুলোর কোনো কিছুই পালন করা হচ্ছে না। ক্রেতাও বেপরোয়া হয়ে ঢলের মতো ছুটছেন দোকানে, মার্কেটে, ঢাকার বাইরে।
সরকারের সর্বোচ্চ পরামর্শক কমিটির ওই চেয়ারম্যান বলেন, এখন প্রয়োজনে আবার সব কিছু বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা সরকারকে সেই পরামর্শ দেবো। কারণ এর মধ্যেই দেশে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ঢুকে পড়েছে। এটা যুক্তরাজ্য, চীন, ইতালি কিংবা সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত ছড়াতে সক্ষম। তিনি বলেন, আমরা খুবই উদ্বিগ্ন ঈদের পরে কি পরিণতি হবে সেই আশঙ্কায়।