Site icon দেশের পত্রিকা – দেশের পত্রিকা দেশের কথা বলে

ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে মহামারি ঘোষণা

অনলাইন ডেস্ক :

 

 

 

 

ভারতে দেখা দেওয়া ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে (মিউকোরমাইকোসিস) মহামারি হিসেবে ঘোষণা করতে প্রতিটি রাজ্যকে নির্দেশ দিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া একটি চিঠিতে এ কথা বলা হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে।

 

 

 

 

 

ইতোমধ্যে রাজস্তান ও তেলেঙ্গানা রাজ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে মহামারি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

 

 

 

এই ভয়ংকর ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ কী?

 

ভারতে যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণের ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউ কেড়ে নিচ্ছে বহু মানুষের জীবন, তছনছ করে দিচ্ছে জনজীবন, তখন ভারতের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো এখন ধরা পড়ছে কোভিড থেকে আরোগ্যের পথে বা সুস্থ হয়ে ওঠাদের শরীরে বিরল এক সংক্রমণ- যার নাম “ব্ল্যাক ফাঙ্গাস” বা বৈজ্ঞানিক নাম মিউকোরমাইকোসিস।

 

 

 

 

 

বিরল এই ছত্রাকের সংক্রমণ খুবই মারাত্মক, যা নাক-চোখ ও কখনও কখনও মস্তিষ্কেও আক্রমণ করে। এই রোগে আক্রান্তদের অস্ত্রোপচার চালিয়ে  চোখ কেটে ফেলতে হচ্ছে।

 

 

 

 

 

লক্ষ্মণগুলো কেমন? 

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশনের লক্ষণের বিষয়ে ভারতীয় চিকিৎসকদের অনেকে বলছেন যে, রোগীর চোখ জ্বালাপোড়া করা, নাক বন্ধ থাকা, জ্বর, দৃষ্টিশক্তি কমে আসা-সহ অনেকগুলো লক্ষণ তাদের চোখে পড়েছে।

 

 

 

 

আবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ফুসফুস দুর্বল থাকায় সহজেই ফুসফুসে আক্রমণ করে এই ছত্রাক। এরপর তা ধীরে ধীরে পুরো শরীরেই ছড়িয়ে পড়ে রোগীকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে বলে তারা মনে করেন।

 

 

 

 

নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, চোখ কিংবা গাল ফুলে ওঠা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশনের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। এ ছাড়া, নাক দিয়ে কালো কিছু বেরিয়ে এলে সঙ্গে সঙ্গে বায়োপসি বা পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসা শুরুর জন্য ভারতীয় চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন।

 

 

 

 

 

মিউকোর মাইকোসিস কী ধরনের সংক্রমণ?

মিউকোরমাইকোসিস খুবই বিরল একটা সংক্রমণ। মিউকোর নামে একটি ছত্রাকের সংস্পর্শে এলে এই সংক্রমণ হয়। সাধারণত এই ছত্রাক পাওয়া যায় মাটি, গাছপালা, সার এবং পচন ধরা ফল ও শাকসবজিতে। এটা মাটি এবং বাতাসে এমনিতেই বিদ্যমান থাকে। এমনকি নাক ও সুস্থ মানুষের শ্লেষ্মার মধ্যেও এটা স্বাভাবিক সময়ে থাকতে পারে।

 

 

 

 

 

এই ছত্রাক সাইনাস, মস্তিষ্ক ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বা এইচআইভি/এইডস যাদের আছে, কিংবা কোনো রোগের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম এই মিউকোর থেকে তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

 

 

 

 

 

চিকিৎসকরা বলছেন, মিউকোরমাইকোসিস থেকে মৃত্যুর আশঙ্কা ৫০ শতাংশ। তাদের ধারণা স্টেরয়েডের ব্যবহার থেকে এই সংক্রমণ শুরু হতে পারে। কোভিড-১৯এ গুরুতরভাবে আক্রান্তদের চিকিৎসায় তাদের জীবন বাঁচাতে এখন স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে।

 

 

 

 

 

স্টেরয়েড কোভিড-১৯ আক্রান্তদের ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। করোনাভাইরাসের জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা যখন অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে যেসব ক্ষতি হয় সেই ক্ষতি থামানোর জন্যও ডাক্তাররা কোভিডের চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার করেন।

 

 

 

 

কিন্তু এই স্টেরয়েডের ব্যবহার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি ডায়াবেটিস নেই এমন কোভিড আক্রান্তদের শরীরের রক্তে শর্করার (ব্লাড সুগার) মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণেই মিউকোরমাইকোসিস সংক্রমণ ঘটছে।

 

 

 

 

কাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি?

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ হলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সেটা আরও কমে যায়। এর ওপর কোভিড-১৯এর চিকিৎসার জন্য যখন স্টেরয়েড দেওয়া হয়, তখন সেটা আগুনে ইন্ধান যোগানোর মত হয়ে দাঁড়ায়,’ বলছিলেন মুম্বাইয়ের তিনটি হাসপাতালে কাজ করা ডা. নায়ার।

 

 

 

 

 

করোনাভাইরাসের প্রাণঘাতী দ্বিতীয় ঢেউয়ের তাণ্ডবে ভারতের যেসব শহর মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত, তার একটি হলো মুম্বাই। তিনি বলছেন, তিনি শুধু এপ্রিল মাসেই এই ফাঙ্গাসের সংক্রমণে ভোগা প্রায় ৪০ জন রোগীর চিকিৎসা ইতোমধ্যে করেছেন।

 

 

 

 

 

তাদের বেশিরভাগই ছিলেন ডায়াবেটিসের রোগী, যারা কোভিড সংক্রমণের পর বাসায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তাদের মধ্যে এগারোজনের চোখ অস্ত্রোপচার করে ফেলে দিতে হয়েছে।

 

 

 

 

 

ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের মধ্যে মাত্র ছয়টি শহর – মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, দিল্লি এবং পুনেতে তার মাত্র ছয়জন সহকর্মী চিকিৎসক ৫৮ জন রোগীর মধ্যে এই সংক্রমণের খবর জানিয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই সেরে ওঠার ১২ থেকে ১৫ দিনের মাথায় ছত্রাক সংক্রমণের শিকার হয়েছেন।

 

 

 

 

 

মুম্বাইয়ের ব্যস্ত সিয়ন হাসপাতালে গত দুই মাসে এই ভয়ংকর ছত্রাক সংক্রমণের ২৪ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। ওই হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের প্রধান ডা. রেণুকা ব্র্যাডু জানাচ্ছেন, এর আগে এই কালো ছত্রাক সংক্রমণ বা মিউকোরমাইকোসিসের শিকার হওয়া রোগীর সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল বছরে ছয়টি।

 

 

 

 

 

‘এখন প্রতি সপ্তাহে দুটি থেকে তিনটি কেস আমরা পাচ্ছি। প্যানডেমিকের মধ্যে এটা ভযানক বিপর্যয়কর,’ তিনি জানান।

 

 

 

 

 

দক্ষিণাঞ্চলীয় ব্যাঙ্গালোর শহরের চোখের সার্জেন ডা. রাঘুরাজ হেগড়ে একই ধরনের চিত্র তুলে ধরেছেন। গত দুই সপ্তাহে তার কাছে মিউকোরমাইকোসিসে আক্রান্ত হয়ে ১৯জন রোগী এসেছেন। তাদের বেশিরভাগ অল্প বয়সী। ‘কেউ কেউ এত অসুস্থ ছিল যে আমরা তাদের অস্ত্রোপচারও করতে পারিনি।’

 

 

 

 

 

চিকিৎসকরা বলছেন, তারা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে এই ছত্রাক সংক্রমণের ভয়াবহতা এবং এত দ্রুত তা ছড়ানোর ঘটনায় খুবই বিস্মিত। গত বছর কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময় এই ছত্রাক সংক্রমণ ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

 

 

 

 

 

ডা. নায়ার বলছেন, গত দুই বছরে তিনি মুম্বাইতে ১০টির বেশি কেস পাননি। ‘এবছর চিত্রটা খুবই আলাদা হয়ে দাঁড়িয়েছে,’ তিনি বলছেন।

 

 

 

 

 

ডা. হেগড়ে বলছেন, ব্যাঙ্গালোরে তিনি তার দুই দশকের চিকিৎসা জীবনে বছরে কখনও একটা বা দুটোর বেশি কেস দেখেননি।

 

 

 

 

 

যে কারণে চোখ কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে 

চিকিৎসকরা বলছেন, বেশিরভাগ রোগীই তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছেন দেরিতে, যখন তারা দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছেন। এই পর্যায়ে ডাক্তারের অস্ত্রোপচার করে চোখ ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কারণ, ছত্রাকের মস্তিষ্কে আক্রমণ ঠেকাতে চোখ বাদ দেওয়া ছাড়া তখন বিকল্প থাকে না।

 

 

 

 

 

ভারতের ডাক্তাররা বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীরা দুচোখেরই দৃষ্টি হারাচ্ছেন। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়ানো রুখতে চিকিৎসকদের রোগীর চোয়ালের হাড়ও কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। তবে সেগুলো একেবারে মারাত্মক সংক্রমণের ক্ষেত্রে।

 

 

 

 

 

ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বন্ধ করার জন্য শিরার মধ্যে ইঞ্জেকশন দেবার ওষুধের দাম ভারতীয় মুদ্রায় এক ডোজ ৩,৫০০ রুপি। আর রোগীকে এই ওষুধ দিতে হবে প্রতিদিন আট সপ্তাহ ধরে। এটাই এই রোগের চিকিৎসায় একমাত্র কার্যকর ওষুধ।

 

 

 

 

 

প্রতিরোধ কি সম্ভব?

মুম্বাইয়ের ডায়াবেটিসের চিকিৎসক ডা. রাহুল বক্সি বলেছেন, এই ছত্রাক সংক্রমণ এড়ানো একমাত্র সম্ভব কোভিড-১৯এর রোগীর চিকিৎসার সময় এবং তার সুস্থ হয়ে ওঠার সময় যদি নিশ্চিত করা যায় তাকে সঠিক পরিমাণ স্টেরয়েড দেওয়া হচ্ছে, সঠিক সময় ধরে।

 

 

 

 

 

তিনি বলেন, গত বছর তিনি ৮০০ জন ডায়াবেটিক কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা করেছেন এবং তাদের কেউ কোভিড পরবর্তী ছত্রাক সংক্রমণের শিকার হননি। রোগী সুস্থ হবার পর বা হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর তার রক্তে শর্করার মাত্রা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখা খুবই জরুরি,’ বলেন ডা. বক্সি। তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা।

Exit mobile version