কুষ্টিয়ায় যে কারণে ট্রিপল মার্ডার করেন এএসআই সৌমেন

নিজস্ব প্রতিনিধি :

 

 

 

 

 

 

 

কুষ্টিয়া শহরের কাস্টমস মোড়ে প্রকাশ্যে নারী ও শিশুসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যার পর স্থানীয়রা একজোট হয়ে হাতেনাতে পিস্তলসহ পুলিশের এএসআই সৌমেন মিত্রকে ধরে ফেলে। এ নিয়ে খুলনা পুলিশে তোলপাড় চলছে। এদিকে এএসআই সৌমেন রায় বরখাস্ত ও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

 

 

 

 

 

 

রবিবার (১৩ জুন) সকাল ১১টার দিকে স্ত্রী আসমা খাতুন (৩৪), আসমার আগের ঘরের ছেলে রবিন (৪) এবং স্থানীয় বিকাশকর্মী শাকিল খানকে (২৮) হত্যা করেন সৌমেন। কিন্তু পুলিশের একজন কর্মকর্তা হয়েও ঠান্ডা মাথায় কেন তিনি এই হত্যাকাণ্ড ঘটালেন- এই প্রশ্ন উঠেছে।

 

 

 

 

 

কাস্টমস মোড় এলাকার ব্যবসায়ী ও স্থানীরা জানান, রবিবার বেলা ১১টার দিকে সৌমেন তার স্ত্রী আসমা ও ছেলে রবিনকে নিয়ে কাস্টমস মোড় এলাকায় আসেন। পরে একটি বিকাশের দোকানের সামনে তাদের সাথে দেখা হয় শাকিল হোসেনের। এরপর আসমা, রবিন ও শাকিলের সাথে সৌমেন ঢুকে পড়েন একটি খাবার হোটেলে। সেখানে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। হোটেল মালিক এসময় তাদের অন্যত্র চলে যেতে বলেন। এরপর তারা সেখান থেকে বেরিয়ে পাশের একটি মসজিদের গলিতে যান। সেখানে ও তাদের মধ্যে বাদানুবাদ চলতে থাকে।

 

 

 

 

 

 

একপর্যায়ে সৌমেন তার অস্ত্র বের করে মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করবেন বলে হুমকি দিতে থাকেন। এরপর তিনি আসমা ও শাকিলের দিকে গুলি ছুঁড়তে থাকেন। দুইবার মিস ফায়ার হলে রবিন দৌঁড়ে পালাতে থাকে। সেসময় সৌমেন পেছন থেকে গুলি ছুঁড়লে নিহত হয় রবিন।

 

 

 

 

 

 

এরপর শাকিল ও আসমাকে সৌমেন কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন। তিন জনকে খুন করতে সৌমেন ১১ রাউন্ড গুলি খরচ করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, যা পরে পুলিশও নিশ্চিৎ করেছে।

 

 

 

 

 

 

এরপর ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে সৌমেনকে আটক করে। এসময় পুলিশ এসে সৌমেনকে ধরে নিয়ে একটি বাড়িতে আটকে রাখে। ক্ষুব্ধ জনতা এসময় তাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। পরে পুলিশের অতিরিক্ত সদস্যরা এসে তাকে থানায় নিয়ে যায়।

 

 

 

 

 

 

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. তাপস কুমার সরকার জানান, বেলা ১১টার দিকে গুলিবিদ্ধ নারী, শিশু ও যুবককে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা করে তাদের মৃত পান।

 

 

 

 

 

 

নিহত শাকিল কুমারখালী উপজেলার সাওতা গ্রামের বাসিন্দা মেজবার খানের ছেলে। আসমা একই এলাকার আমির আলীর মেয়ে এবং শিশু রবিন আসমার আগের স্বামীর সন্তান। সৌমেনের সাথে আসমার এটা দ্বিতীয় বিয়ে ছিলো।

 

 

 

 

 

 

আসমার পরিবার এবং স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসমার প্রথম স্বামী স্থানীয় কাঞ্চনপুর গ্রামের রুবেলের সাথে দেড় বছর আগে ছাড়াছাড়ি হয়। রুবেলের সংসার ছেড়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে সৌমেন মিত্রকে বিয়ে করেন আসমা। মিরপুর থানার হালসা পুলিশ ক্যাম্পে কর্মরত থাকার সুবাধে আসমা ও সৌমেন কুষ্টিয়া শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। পরে সৌমেন বদলি হন খুলনার ফুলতলা থানায়। এরপর রবিনকে নিয়ে আসমা ওই ভাড়া বাসায় থাকতেন।

 

 

 

 

 

 

কাস্টমস মোড়ে শাকিলের বিকাশের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের দোকান থাকার সুবাধে আসমার সেখানে যাওয়া-আসা ছিলো। এতে আসমার সাথে শাকিলের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিষয়টি সৌমেন জানার পর আসমাকে সতর্ক করে। এ নিয়ে আসমার সাথে সৌমেনের মনোমালিন্যও হয়।

 

 

 

 

 

 

আসমার মা হাসিনা খাতুন বলেন, আসমা দেড় বছর আগে প্রথম স্বামীকে ছেড়ে চলে এসে সৌমেনকে বিয়ে করে। আসমা ও শাকিলের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিলো না। তবে তারা মোবাইলে নিয়মিত যোগাযোগ করতো।

 

 

 

 

 

 

কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাব্বিরুল ইসলাম জানান, আটক এএসআই সৌমেন মিত্র মাগুরা জেলার বাসিন্দা এবং বর্তমানে তিনি খুলনার ফুলতলা থানায় কর্মরত। সৌমেনকে আটকের পাশাপাশি তার কাছ থেকে হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে সৌমেন নিহত আসমা তার স্ত্রী বলে জানিয়েছে।

 

 

 

 

 

 

ওসি সাব্বিরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সৌমেনের স্ত্র্রী আসমার সাথে বিকাশকর্মী শাকিলের কোনো সম্পর্ক বা আর্থিক লেনদেনের ঝামেলা থাকতে পারে। অথবা আসমা, সৌমেন ও শাকিলের মধ্যে ত্রিমুখী কোনো সম্পর্কের দ্বন্দ্বেও হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে। পুলিশ সবগুলো বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করছে।

 

 

 

 

 

 

খুলনা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুব হাসান বলেন, ‘কুষ্টিয়ায় আটক সৌমেন ফুলতলা থানার এএসআই। আজ সকাল থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। তিনি ছুটি না নিয়ে আন-অফিশিয়ালি কুষ্টিয়ায় গেছেন। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

 

 

 

 

 

 

কে এই সৌমেন মিত্র

 

২০০৪ সালে পুলিশে কনস্টেবল পদে চাকরি পান সৌমেন। তার বাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলার কসবা গ্রামে। কুষ্টিয়া পুলিশ সূত্র জানায়, সৌমেন রায় ২০১৫ সালে কনস্টেবল থেকে এএসআই পদে উন্নীত হন। পরে ২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানায় যোগ দেন। সেখান থেকে জেলার অন্যান্য থানায়ও কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ মিরপুর থানার হালসা ক্যাম্পে ছিলেন। এরপর বাগেরহাট হয়ে খুলনা ফুলতলা থানায় যোগ দেন।

 

 

 

 

 

 

এর মধ্যে আসমার সাথে তার পরিচয় হয়। তখন সৌমেন কুষ্টিয়ার মিরপুর, ইবি, কুমারখালী থানাসহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করে। এর আগে সৌমেন ২০০৫ সালে আথি রায় নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। সেই ঘরে তার এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। তারা খুলনায় বসবাস করে।

 

 

 

 

 

 

সৌমেনের সাথে বিয়ের আগে আসমার আরো দুটি বিয়ে হয়। প্রথম ঘরে এক মেয়ে ও দ্বিতীয় ঘরে রবিনের জন্ম হয়। আসমা পরে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে আঁখি নাম ধারণ করেন। আসমা খাতুন ওরফে আঁখির গ্রামের বাড়ি বাগুলাটের নাতুড়িয়া গিয়ে কথা বললে প্রতিবেশীরা জানান, এলাকায় তারা থাকেন না। পরিবারসহ কুষ্টিয়ায় আমলাপাড়ায় ভাড়া থাকেন। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, আঁখিকে সে শহরে বাসা ভাড়া করে দেয়। মাঝেমধ্যে সে এসে তাদের সাথে থাকত।

 

 

 

 

 

 

পরকীয়া সম্পর্কই এ খুনের প্রধান কারণ

 

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর সৌমেন রায় পুলিশকে যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে শাকিলের সাথে আসমার পরকীয়ার সম্পর্কই এ খুনের প্রধান কারণ’ হতে পারে বলে ধারণা করছে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ।

 

 

 

 

 

জেলা পুলিশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে এ তথ্য দিয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কিছু বলছে না কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ।

 

 

 

 

 

 

কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক কারণ আমরা জানতে পারিনি। এ বিষয়ে তদন্ত করে পরে বিস্তারিত জানানো হবে।

 

 

 

 

 

 

আসমার সাথে বেশ কয়েকজন যুবকের সম্পর্ক চলছিল বলে পুলিশকে জানিয়েছে সৌমেন। বিষয়টি জানতে পেরে সৌমেন কললিস্টসহ বিভিন্ন প্রমাণ সংগ্রহ করে।

 

 

 

 

 

 

সর্বশেষ শাকিলের সাথে আসমা ওরফে আঁখির সম্পর্ক চলছিল বলে সৌমেন নিশ্চিৎ হয়। শনিবার সৌমেন আঁখিকে ফোন করে জানান, তাদের তিনি খুলনায় নিয়ে যাবেন। পরে কুষ্টিয়ায় এসে সৌমেন শাকিল প্রসঙ্গে আঁখির সাথে তর্কে জড়ান।

 

 

 

 

 

 

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের সাঁওতা এলাকায় নিহত শাকিলের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার মরিয়ম খাতুন ও ভাবি লতার সাথে। তারা বলেন, শাকিলের সাথে আসমার চেনাজানা ছিলো। আমরা জেনেছি, তাদের মধ্যে ভাইবোনের সম্পর্ক ছিলো। এর বাইরে কোনো গোপন সম্পর্ক ছিলো কি-না, তা আমরা জানি না। একদিন আমাদের বাড়িতে সৌমেন আসেন। তিনি জানান, গোপন সম্পর্কের কথা। শাকিল যেন আসমার সাথে না মিশে, সে জন্য আমাদের বলে যায়।

 

 

 

 

 

 

আসমার গ্রামের বাড়ি বাগুলাটের নাতুড়িয়া গ্রামে। তার প্রতিবেশীরা জানান, আসমার পরিবারের কেউ গ্রামে থাকে না। তারা কুষ্টিয়াতে ভাড়া বাসায় থাকতেন।

 

 

 

 

 

 

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) খায়রুল আলম জানান, শাকিলের সাথে আসমার পরকীয়া সম্পর্কের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলটি জব্দ করা হয়েছে। আইন সবার জন্য সমান। অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

 

 

 

 

 

এএসআই সৌমেন রায় বরখাস্ত, তদন্ত কমিটি গঠন

 

কুষ্টিয়ায় প্রকাশ্যে গুলি করে তিনজনকে হত্যার ঘটনায় আটক এএসআই সৌমেন রায়কে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিকেলে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

 

 

 

 

 

 

এদিকে এ ঘটনায় খুলনা রেঞ্জ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। খুলনা রেঞ্জের দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ কুষ্টিয়ায় এক পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।

 

 

 

 

 

বিকেলে জানতে চাইলে খুলনা জেলার পুলিশ সুপার মাহবুব রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ঘটনা জানার পর সৌমেন রায়কে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এরপর তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে সর্বশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *