ফেরেশতারা যেভাবে ইবাদত করেন

ফেরেশতা মহান আল্লাহর রহস্যময় এক সৃষ্টি। আল্লাহ অপরিমেয় শক্তির আধার করে সৃষ্টি করেছেন ফেরেশতাকুলকে। একান্ত অনুগত এই বাহিনীর ওপর ন্যস্ত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক দায়িত্ব। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য জায়গায় ফেরেশতাদের মর্যাদাপূর্ণ বর্ণনা এসেছে। কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুসারে ফেরেশতারা নূরের তৈরি এক বিশেষ সৃষ্টি। তাঁরা সব ধরনের জৈবিক চাহিদা থেকে মুক্ত। মর্যাদা ও দায়িত্বের বিচারে ফেরেশতারা একাধিক শ্রেণিতে বিভক্ত। তাঁদের সংখ্যাও অগণন। তাঁদের সংখ্যা ও শ্রেণি সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁরা বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে পারেন এবং তাঁদের শক্তি মানুষের স্বপ্নাতীত। প্রধান চার ফেরেশতা হলেন হজরত জিবরাঈল, হজরত মিকাঈল, হজরত আজরাঈল ও হজরত ইসরাফিল (আ.)।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ফেরেশতাদের ‘নিজের অনুগত ও সম্মানিত বান্দা’ হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছে। আল্লাহ এ থেকে পূতপবিত্র। বরং তারা আল্লাহর সম্মানিত বান্দা।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ২৬) আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ফেরেশতারা আল্লাহর সম্মানিত বান্দা। তাঁদের মর্যাদা সমুন্নত ও উচ্চ। কথা ও কাজে তাঁরা আল্লাহর পরিপূর্ণ অনুগত। তাঁরা আল্লাহর আদেশ অমান্য করেন না। আল্লাহর আদেশ মান্য করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। বরং আল্লাহর নির্দেশই তাঁদের ক্রিয়াশীল করে এবং তাঁদের কাজের সুযোগ করে দেয়। সৃষ্টিজগতের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন ছাড়াও আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন থাকা ফেরেশেতাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোরআন ও হাদিসে তাঁদের ইবাদতের বিভিন্ন বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন—

তাসবিহ পাঠ : ফেরেশতারা সর্বদা আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকেন। তাসবিহ পাঠের (আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা) মাধ্যমে তাঁরা আল্লাহকে স্মরণ করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়, ‘ফেরেশতারা আল্লাহর সপ্রশংস তাসবিহ পাঠ করে।’ (সুরা : আশ-শুরা, আয়াত : ৫) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তারা দিন-রাত তাসবিহ পাঠ করে। তারা ক্লান্ত হয় না।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ২০)

আর ফেরেশতারা আল্লাহর যে তাসবিহ ও পবিত্রতা ঘোষণা করেন, তা নিঃসন্দেহে আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম স্মরণ। হজরত আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়, কোন জিকিরটি উত্তম? তিনি বলেন, আল্লাহ যা তাঁর ফেরেশতা ও বান্দাদের জন্য নির্বাচন করেছেন—সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি। অর্থ : আল্লাহ পূতপবিত্র এবং সব প্রশংসা শুধু তাঁর জন্যই। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৯১৬)

নামাজ ও সিজদা : হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ এমন একদল ফেরেশতা তৈরি করেছেন, যাঁরা সর্বদা নামাজ আদায় করছেন। তাঁদের কেউ কেউ সিজদারত অবস্থায় রয়েছেন, কেউ রুকুতে রয়েছেন। আর তাঁরা নামাজ আদায় করছেন সারিবদ্ধ হয়ে ও সুশৃঙ্খলভাবে। হজরত জাবের ইবনে সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা কি সারিবদ্ধ হবে না, যেমন ফেরেশতারা আল্লাহর নিকট সারিবদ্ধ হয়ে থাকে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৫৬)

হজরত হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ বলেন, আসমানে এমন এক বিঘত জায়গা নেই, যেখানে কোনো ফেরেশতা সিজদা বা নামাজরত নেই। (তিবরানি) আর সুরা সাফফাতের ১৬৬ নম্বর আয়াতে ফেরেশতাদের জবানিতে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমরা আপনার সিজদাকারী।’

হজ : মানুষের মতো ফেরেশতাদের জন্য রয়েছে কাবা। তাঁরা সেই কাবাঘরের জিয়ারত করেন, তাওয়াফ করেন, হজ পালন করেন। সপ্তম আসমানে অবস্থিত আল্লাহর এই ঘরের নাম বায়তুল মামুর। আল্লাহ তাআলা সুরা তুরে বায়তুল মামুরের কসম করেছেন। ইমাম তাবারি (রহ.) বলেন, বায়তুল মামুর জমিনে অবস্থিত কাবার আকৃতিতে তৈরি আসমানে অবস্থিত একটি ঘর, যেখানে আল্লাহর জিকির হয়। প্রতিদিন সেখানে ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করেন, যাঁরা দ্বিতীয়বার সেখানে প্রবেশ করেন না। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, সহিহ বুখারি ও মুসলিমে প্রমাণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) মিরাজ বিষয়ক হাদিসে বলেন, ‘অতঃপর আমাকে বায়তুল মামুরের দিকে উড্ডয়ন করানো হলো, যেখানে প্রতিদিন ৭০ হাজার (ফেরেশতা) প্রবেশ করে। তাদের কেউ দ্বিতীয়বার ফিরে আসে না। অর্থাৎ তারা সেখানে ইবাদত করে এবং এই ঘরের তাওয়াফ করে, পৃথিবীতে মানুষ যেভাবে কাবাঘরের তাওয়াফ করে। বায়তুল মামুর হলো আসমানবাসীর কাবা। হজরত ইবরাহিম (আ.) পৃথিবীতে কাবাঘর তৈরি করার কারণে বায়তুল মামুর প্রাঙ্গণে বিশেষ স্থান লাভ করেছেন।

আল্লাহর ভয় : যে বান্দা আল্লাহ সম্পর্কে যতটুকু জানে সে আল্লাহকে ততটুকুই ভয় পায়। যেহেতু ফেরেশতারা আল্লাহ সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখেন, তাই তাঁরা আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় পান। আল্লাহর ভয়ে তাঁরা ভীত ও বিনম্র হয়ে থাকেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে এবং তিনি যা আদেশ করেন তা পালন করে।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৫০)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন আল্লাহ আসমানে কোনো নির্দেশ জারি করেন, ফেরেশতারা আল্লাহর ভয়ে তাদের পাখা দিয়ে আঘাত করতে থাকে, যেভাবে পাথরের ওপর শিকল দিয়ে আঘাত করা হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৯৫৪)

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা আল্লাহর ভয়ে বিনম্র।’    (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ২৮)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *