শেখ রাকিব নিহাল (জয়) আমেরিকা প্রবাসী :
আমরা যারা দেশের বাইরে আসি তাঁদের একেক জনের একেক উদ্দেশ্য থাকে। নিজের দেশ, নিজের জন্মভূমি, নিজের দেশের মাটি আর প্রবাস জীবনের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। প্রবাসী জীবনে আপনি রাস্তায় হাঁটেন বা কোথাও বেড়াতে যান কিংবা অফিসে কাজ করেন, সব জায়গাতেই আপনি যে প্রবাসী তা অন্য সবাই প্রমাণ করে দেবে। হয় বেশি খাতির করে, না হয় ওদের ভাষা আর আপনার ভাষার তফাত তুলে ধরে। হ্যাঁ কথাটা সত্য! কিন্তু আমরাও চাই স্বাভাবিক হতে, সবার সঙ্গে চলতে, কথা বলতে। প্রবাসে আমরা সব সময় যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হই তার মধ্যে প্রথমেই আসে ভাষার সমস্যা। এর জন্য চাই যে দেশে আছেন সে দেশের ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা।
কিন্তু এটা একজন পূর্ণ বয়ষ্কের জন্য খুবই কষ্টকর। একজন ততটুকু শিখতে পারে যতটুকু তার নিজের চলার জন্য প্রয়োজন। এজন্য ভাষাগত একটা বড় ব্যবধান থেকে যায়। এরপরই আছে খাবার দাবারের কষ্ট। আমরা বাঙ্গালিরা ভাত, ডাল, মাছ আর মায়ের হাতের মমতা দিয়ে রান্না করা বাংলার টাটকা সতেজ সবজি, ভাজি খেতে অভ্যস্ত। এর বদলে যে কোনো দেশের যত ভাল খাবারই হোক না কেন কিছু দিন পর তা আর ভালো লাগে না। বিদেশে ওই দেশের প্রচলিত খাবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রত্যেককে রীতিমত মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। তারপরও চলাফেরা, বন্ধু বান্ধব সে তো আর এক বাস্তবতা। এরপর বলা যায় বন্ধুত্বের কথা।
বন্ধু বলতে আমরা বাঙালিরা যা বুঝি, যা জানি, যে ছবি মনের মাঝে ভাসে, সেটা থেকে আমার মনে হয় বিশ্বের অন্য সব দেশের বন্ধুত্বের সংজ্ঞা ভিন্ন। আমরা বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাব, আড্ডা মারবো, ঘুরবো, সন্ধ্যায় কোনো এক চায়ের দোকান অথবা খেলার মাঠে অথবা বাজারে অথবা পছন্দের কোনো জায়গায় বসা, হাসি-তামাশা করা, গল্প করতে করতে বাসায় ফেরার সময় পার হয়ে যাওয়া । কারণ সময়ের কথা কারও মনে থাকে না। এত কিছুর পরও প্রবাসীরা হাসিমুখে সব মেনে নেয় কারণ প্রবাসী সবাই একটা স্বপ্ন নিয়ে প্রবাস জীবন বেছে নেয়।
এরপর পরিবারের মানুষও যখন কথা বলে বা চিঠি লেখে তখন কেমন আছিস, কোনো চিন্তা করিস না, আমরা ভালো আছি, বাড়ির কোনো সমস্যা অথবা সমস্যার সমাধান, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত হচ্ছে কিনা এই বিষয়গুলোই বলে। কেউ কেউ অনেক সময় ঝগড়া করে, তর্ক করে, নালিশ করে। আমার মনে হয় দেশে থেকে অনেকেই (অন্তত যাদের প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা নাই) একজন প্রবাসীর মনের অবস্থা, তাঁর একাকিত্ব, তাঁর আবেগ, তাঁর কষ্ট, তাঁর উদাসীনতা, তাঁর নীরব কান্না এগুলো বুঝতে পারে না। এটা সত্য যে এই অনুভূতিগুলো অনুভব করাও তাদের পক্ষে সম্ভব না। প্রবাসী জীবনে প্রবাসীরাই এগুলো বেশি অনুভব করেন। প্রবাস জীবনে কেউ দুঃখ পায় না, কারণ দুঃখ পেতে আপনজন প্রয়োজন হয়। আপনজন ছাড়া অন্য কেউ দুঃখ দিতে পারে না। প্রবাস জীবন এমনই যে এই জীবনে দুঃখ পাওয়া যায় না। তবে প্রবাস জীবনের সঙ্গী হয় কষ্ট এবং তা এমন ভাবে লেগে থাকে যে পিছুই ছাড়তে চাই না। দুঃখ এবং কষ্টের মাঝে যে বিশাল ব্যবধান তা প্রবাসীদের মতো অন্য কেউ অনুভব করতে পারে না।
প্রবাসে প্রবাসীরা যা অর্জন করেন সেটা অর্থ কিংবা শিক্ষা যাই হোক না কেন সেটা তাঁর অবর্ণনীয় কষ্টের ফসল ছাড়া কিছুই না। আপনাদের কাছে অনুরোধ, যারা দেশে আছেন আর বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন অথবা পুত্র-কন্যা কিংবা স্বামী-স্ত্রী যেই প্রবাসী হোক না কেন সব কিছুর মধ্য দিয়ে প্রবাসীদের সেই কষ্ট, অনুভূতি, বেদনা, নীরব কান্না একটু বোঝার চেষ্টা করবেন। তাঁদেরকে যতখানি সম্ভব একাকিত্ব থেকে দূরে রাখবেন, তাঁদেরকে যতখানি সম্ভব নিজেদের কাছে রাখার চেষ্টা করবেন।
সূত্র: প্রথম আলো