ডিপি ডেস্ক :
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব শুরু হচ্ছে আজ। সনাতনী রীতি অনুযায়ী, প্রতি বছর চন্দ্র আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা।
বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাসহ নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে আনন্দমুখর পরিবেশে ৯ দিনব্যাপী শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা মহোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। আগামী ১৫ জুলাই বিকাল ৩টায় উল্টো রথের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে এ উৎসব শেষ হবে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, জগন্নাথদেব হলেন জগতের নাথ বা অধীশ্বর। জগৎ হচ্ছে বিশ্ব আর নাথ হচ্ছেন ঈশ্বর। তাই জগন্নাথ হচ্ছেন জগতের ঈশ্বর। তার অনুগ্রহ পেলে মানুষের মুক্তিলাভ হয়। জীবরূপে তাকে আর জন্ম নিতে হয় না। এ বিশ্বাস থেকেই রথের ওপর জগন্নাথ দেবের প্রতিমূর্তি রেখে রথ নিয়ে যাত্রা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
শুভ রথযাত্রা উপলক্ষে ঢাকায় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) ৯ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে হরিনাম সংকীর্তন, বিশ্বশান্তি ও মঙ্গল কামনায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা, পদাবলি কীর্তন, আরতি কীর্তন, ভগবত কথা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শ্রীমদ্ভাগবত গীতা পাঠ, ধর্মীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও ধর্মীয় নাটক মঞ্চায়ন।
আজ ইসকন আশ্রমে বিশ্বশান্তি ও মঙ্গল কামনায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞের মধ্য দিয়ে রথযাত্রা উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। দুপুর দেড়টায় আলোচনা সভা শেষে আড়াইটায় রথের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার উদ্বোধন করা হবে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। শোভাযাত্রা উদ্বোধন করবেন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে স্থানীয় সংসদ সদস্য সাঈদ খোকন উপস্থিত থাকবেন। ১১ ও ১২ জুলাই আলোচনা সভায় অতিথি থাকবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ও ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ।
রথের শোভাযাত্রা স্বামীবাগ আশ্রম থেকে শুরু হয়ে জয়কালী মন্দির-ইত্তেফাক মোড়-শাপলা চত্বর-দৈনিক বাংলা মোড়-রাজউক ভবন-গুলিস্তান-পুলিশ হেডকোয়ার্টার-সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল-হাইকোর্ট মাজার-দোয়েল চত্বর-রমনা কালী মন্দির-টিএসসি মোড়-জগন্নাথ হল ও পলাশী হয়ে শ্রীশ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে গিয়ে শেষ হবে। ১৫ জুলাই বিকেলে উল্টো রথের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা একই পথে ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে স্বামীবাগ আশ্রমে আনা হবে।
ইসকনের সভাপতি সত্যরঞ্জন বাড়ৈ বলেন, এবারও উৎসবমুখর পরিবেশে রথযাত্রা হবে। শোভাযাত্রায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী নিয়োজিত থাকবে। মহোৎসব সফল করতে সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শোভাযাত্রাসহ উৎসব উপলক্ষে নিরাপত্তায় নিজস্ব প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত থাকবে। তিনি বলেন, রথযাত্রায় সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ অংশ নিতে পারবেন।
উল্লেখ্য, সনাতন ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা। ভারতে বঙ্গোপসাগরের পূর্বউপকূলে উড়িষ্যা (বর্তমান ওড়িশা) নামক রাজ্যে অবস্থিত পুরীর জগন্নাথ মন্দির। সেই শ্রীমন্দির থেকে গুণ্ডিচা মন্দিরে রথে চড়ে ভগবান শ্রী জগন্নাথ দেবের যাত্রাই রথযাত্রা নামে অভিহিত। এ যাত্রার প্রধান তিন বিগ্রহ- জগন্নাথ (কৃষ্ণ), বলদেব (বলরাম) ও সুভদ্রা (শ্রীকৃষ্ণের ভগিণী ও যোগমায়াশক্তি)। সাধারণত তিনটি রথে এ তিন বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। প্রতি বছর আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এর সাত দিন পর জগন্নাথদেব যখন গুণ্ডিচা মন্দির থেকে আবার তার শ্রীমন্দিরে ফিরে আসেন, তাকে বলা হয় উল্টো রথযাত্রা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন এই রথযাত্রা মহোৎসব।
রথযাত্রার সূচনা কবে থেকে তার সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ত্রয়োদশ শতাব্দীতেও রথযাত্রা উদযাপিত হতো- এমন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া ‘রথ চকদ’ নামক প্রাচীন গ্রন্থ অনুসারে ৮ম শতাব্দীতে রাজা যযাতি কেশরী কর্তৃক রথযাত্রা উদ্যাপনের ইতিহাস পাওয়া যায়। স্কন্দ পুরাণ অনুসারে, সত্যযুগে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন কর্তৃক জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সময় থেকে রথযাত্রা উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা মহোৎসবের উল্লেখযোগ্য দিক এর সামাজিক মেলবন্ধন। ‘জগন্নাথ’ শব্দের অর্থ- জগতের নাথ তথা সকলের পরম প্রভু। জগন্নাথ সকলের নাথ, তার কাছে ব্রাহ্মণ-শূদ্র, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো প্রভৃতি মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সেজন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ এ রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারে। এভাবে সকলের মধ্যে সৌহার্দ্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ববোধ তথা সামাজিক মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে হিংসা-বিভেদহীন এক সুশৃঙ্খল সমাজ। তাই রথযাত্রা হলো ধর্মীয় ও সমাজিক সম্প্রীতির মিলনমেলা।
রথযাত্রা বিভিন্ন নামে পরিচিত। পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দির থেকে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার প্রচলন হয়। বাংলাদেশেও রথযাত্রা হিন্দুদের একটি পবিত্র উৎসব। ঢাকার ধামরাইয়ে এটি পরিচিত যশোমাধবের রথযাত্রা নামে। গাজীপুরের জয়দেবপুরে মানিক্যমাধবের রথযাত্রা। ভারতের ওড়িষ্যা রাজ্যের যশোমাধবের রথযাত্রা ও মহেশের জগন্নাথদেবের রথযাত্রাও উপমহাদেশ বিখ্যাত। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে রথযাত্রার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের জগন্নাথ জিউ ঠাকুর মন্দির, জয়কালী রোডের রামসীতা মন্দির এবং শাঁখারীবাজার একনাম কমিটিসহ রাজধানীর অন্যান্য মন্দির ও দেশের বিভিন্ন মন্দিরেও রথটান অনুষ্ঠিত হবে। বাসস