অনলাইন ডেস্ক :
পারস্পরিক আস্থা বাড়ানো ও স্থিতিশীলতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতি দুই প্রতিবেশীই আগ্রহ দেখিয়েছে। দুই দেশের সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহযোগিতার ইচ্ছাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের বিষয়টির সুরাহা না হলে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক কিভাবে এগিয়ে যাবে, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘অবশ্যই এটি একটি ইস্যু, আমাদের মধ্যে আরো অনেক দ্বিপক্ষীয় ইস্যু আছে।
দুই দেশের মধ্যে আস্থা, সম্মান ও উদ্বেগ এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারস্পরিক সংবেদনশীলতার ওপর ভিত্তি করে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক নির্মাণে ইচ্ছার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। গেল ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফরকালে তিনি এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব আরো বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের মূল অংশীদার হলো দুই দেশের জনগণ। বাণিজ্য, কানেকটিভিটি ও অন্যান্য সক্ষমতা বৃদ্ধির খাতগুলোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগিতা ও বহুমুখী সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই করা হবে। এখন পর্যন্ত এটিই আমাদের অভিমুখ। এরই মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে।’
ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক লালনে নিজেদের অভিমুখের কথা জানিয়ে দিয়েছেন তারা। এতে গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, অগ্রসর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।
গেল ৩১ ডিসেম্বর ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে যান বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা তাকে স্বাগত জানান।
এরপর ২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের একটি আদালতে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করার ঘটনায় নরম প্রতিক্রিয়া দেখায় ভারত। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
‘গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা যাতে ন্যায়বিচার পান, এতটুকুই আমাদের প্রত্যাশা। আশা করি, বাংলাদেশ সেই ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবে,’ বলেন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র।
এরই মধ্যে বাংলাদেশে আটক থাকা ৯৫ ভারতীয় মৎস্যজীব ও নৌকর্মীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বিপরীতে একইভাবে ৯০ বাংলাদেশি মৎস্যজীবী ও নৌকর্মীকে নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে ভারত। আগামীকাল ৫ জানুয়ারির মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এদিন আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাংলাদেশি মৎস্যজীবী ও নৌকর্মীকে হস্তান্তর করার পর ৬ জানুয়ারি দুপুরে তারা চট্টগ্রামে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া ভারত থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও বাংলাদেশে আসছে। গেল ডিসেম্বরে ২৪ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন সিদ্ধ চালের একটি চালান ভারত থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম কোনো ভারতীয় পণ্যের চালান বাংলদেশে আসে।
পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকসহ সাম্প্রতিক কূটনৈতিক যোগাযোগ বলে দিচ্ছে, নতুন সম্পর্ক বিনির্মাণের পাশাপাশি বিরোধের জায়গাগুলো মিটিয়ে ফেলতে দুদেশই অঙ্গীকারাবদ্ধ।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মরণে দুই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত-বাংলাদেশ। দুই প্রতিবেশীর পারস্পরিক বিজয় দিবস উদযাপনে সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা অংশ নেন। এই দ্বিপাক্ষিক সফরের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় প্রবীণ যোদ্ধারা এক অনন্য বন্ধুত্ব উদযাপনের সুযোগ পান। পাশাপাশি তারা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতিচারণও করতে পারেন। যা নিপীড়ন, গণহত্যা ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত-বাংলাদেশের মিত্রবাহিনীর আত্মত্যাগকে প্রতীকায়িত করে।
এসব ঘটনাকে শেখ হাসিনার পতন ও তার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে যে প্রতিকূলতা তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে যৌথ প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নিয়ে আমি আশাবাদী। যদিও চারপাশে অনেক পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে। দুই দেশই পরস্পরের দিকে এমনভাবে এগিয়ে যেতে পারে, যাতে তাদের অন্য কোথাও যেতে না হয়।
তিনি বলেন, ‘পরস্পরের জন্য মঙ্গলজনক এমন দৃরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক, গঠনমূলক ও স্থিতিশীল সম্পর্কের প্রত্যাশা করছে দিল্লি। কাজেই সম্পর্কের অবনতি ঘটছে, এমন ধারণাগুলো ঠিক না, সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি।’
পরবর্তী ফোনালাপে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বার্তা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পৌঁছে দেন হাইকমিশনার। আগামী ১৭ আগস্ট নয়াদিল্লিতে ভার্চ্যুয়ালি আয়োজিত দ্য থার্ড ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিটে অংশ নিতে অধ্যাপক ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মোদি।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর ও তার বাংলাদেশি সমকক্ষ তৌহিদ হোসেনের মধ্যে বৈঠকের কথাও উল্লেখ করেন ভারতীয় এই কূটনীতিক। এছাড়া পরিস্থিতির যে অবনতি হচ্ছে না, তা নিয়ে আভাস দিতে সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত হওয়া পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ফরেন অফিস কনসাল্টেশনের কথাও বলেন তিনি।
প্রণয় ভার্মা বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃঢ়তা আছে। এছাড়া ভারত থেকে বাংলাদেশে অপরিহার্য পণ্যও আসছে। এছাড়াও সম্ভবত অন্য দূতাবাসগুলো সবাই মিলে যা দিচ্ছে, তার চেয়েও বেশি ভিসা ইস্যু করছে ভারতীয় দূতাবাস।
নতুন নতুন অর্থনৈতিক সুবিধাদির জন্য ভৌগোলিক নৈকট্য কাজে লাগানোর প্রতি জোর দেন ভারতীয় হাইকমিশনার।
বিশ্লেষকরা বলেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যত অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অনুঘটকের ওপর নির্ভর করছে। অর্থনৈতিক স্বার্থ, ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও নিরাপত্তা উদ্বেগের মতো আসন্ন প্রতিকূলতাও সম্পর্কের ভবিষ্যত নির্ধারণ করে দিতে পারে।(সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ)