

দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি :
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে খোলস ছেড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে দীর্ঘদিন ধরে ঘাপটি মেরে থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে তৎপর হয়ে উঠেছে চরাঞ্চলের ত্রাস চল্লিশ বাহিনী সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী। এসব বাহিনীর সন্ত্রাসীরা আতঙ্ক ছড়াতে এলাকায় মাঝে মধ্যে গুলিবর্ষণ, বোমা হামলা, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, গরু-মহিষ ও ফসল লুটসহ খুনের ঘটনাও ঘটাচ্ছে। ফলে ভীত সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে চরের সাধারণ মানুষ। এছাড়াও সীমান্ত দিয়ে অবাঁধে আসছে মাদক ও অস্ত্র। আর এসব অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর।
অনুসন্ধানে ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে থাকা চরাঞ্চলে কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এসব সংগঠন নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে মাঝে মধ্যে নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে।
এরমধ্যে রয়েছে লালচাঁদ বাহিনী, চল্লিশ বাহিনী ওরফে রাখি বাহিনী, সাঈদ বাহিনী, শরিফ কাগি বাহিনী, হানিফ বাহিনী, সজল বাহিনী ও কাকন বাহিনী অন্যতম। এ সকল সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের চরাঞ্চলে প্রাকাশ্যে অপ্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। গরু ও মহিষ লুটের টাকার ভাগ নিয়ে প্রকাশ্যে নিজেদের মধ্যে লিপ্ত হয়েছে গোলাগুলিতে। যা সবারই জানা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ৩০ সেপ্টেম্বরে প্রকাশ্যে দিবালোকে নিজ কার্যালয়ে ফিলিপনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নঈম উদ্দিন সেন্টুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই বছরের ২ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে উপজেলা বাজারের ফিড ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামকে অস্ত্রের মুখে মারপিট করে ব্যবসার ৫ লাখ টাকা, স্বর্ণালংকার ও মোবাইলফোন ছিনতাই করে নেয় চল্লিশ বাহিনীর প্রধান রাখি ও তার বাহিনীর সদস্যরা।
এ ঘটনার কয়েকদিন আগে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাড়ি ফেরার পথে বেলা ১১টার দিকে শিতলাইপাড়া এলাকায় ভাংড়ি ব্যবসায়ী স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা ভর্তি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় মোটরসাইকেল যোগে আসা ছিনতাইকারীরা। ১৪ জানুয়ারি বিকেলে হরিণগাছী এলাকায় নগদের মার্কেটিং অফিসারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে ১ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকা ছিনতাইয় করে নিয়েছে সশস্ত্র ছিনতাইকারী চক্র। ১ ফেব্রুয়ারি রাত ২টার দিকে উপজেলার আদাবাড়ীয়া ইউনিয়নের তেকালা এলাকায় আতঙ্ক ছড়াতে একটি নির্মাণাধীন সেতুর শ্রমিকদের রাত্রি যাপনের অস্থায়ী ঘর লক্ষ্য করে ৫-৬টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো হয়।
এদিকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি সীমান্তে মাদক চোরাচালানকে কেন্দ্র করে চোরাকারবারি দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে এক মাদক চোরাকারবারী পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে কৃষক দম্পতিকে বেঁধে রেখে গরু ও ছাগল লুট করা হয়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীরচর ভাঙ্গাপাড়া গ্রামের ইব্রাহিম প্রামাণিকের ছেলে রাজু হোসেন (১৮) নামে এক যুবককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পদ্মার চরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন সকালে একই এলাকার সাঈদ মণ্ডলের চরের বাথান থেকে অন্তত ৪৬টি মহিষ ও ১৫টি গরু লুট করে সন্ত্রাসীরা। একইদিন রাতে ফিলিপনগর ইউনিয়নের আবেদের ঘাট এলাকায় কালু কবিরাজের বাথান থেকে ৩৪টি গরু লুট করা হয়। এ ছাড়াও চরাঞ্চলের আরও কয়েকটি বাথানে গরু-মহিষ ও ফসল লুটের ঘটনা ঘটিয়েছে সন্ত্রাসীরা। গরু লুটের টাকার ভাগ নিয়ে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। কালু কবিরাজের গরু লুটের টাকার ভাগ নিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে সন্ত্রাসীরা বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। ফিলিপনগর ইউনিয়নের চরসাদীপুর বাজারের পাশে পাঁচশবিঘা মাঠে নিজেরা একে অপরকে লক্ষ্য করে গোলাগুলি করে।
চরসাদীপুর এলাকার চিহ্নিত ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী নাজমুল, শাহীন ও জামিল প্রতিপক্ষ ফিলিপনগর এলাকার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনী প্রধান শরিফ কাইগি ও রিন্টুকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। জবাবে শরিফ কাইগি ও রিন্টুও তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পাল্টাপাল্টি গুলিতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে।
এছাড়াও প্রায় দিনই দিনে দুপুরে ছিনতাইয়ের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এসব ঘটনায় থানায় অভিযোগ করতেও সাহস পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। তবে ফিড ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের দায়ের করা মামলায় বাহিন প্রদান রাখি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফিলিপনগর এলাকার অনেকে জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে দৌলতপুরের পদ্মার চরাঞ্চলে গড়ে ওঠে লালচাঁদ বাহিনী ও ছাপাত-পান্না বাহিনী। এক দশক ধরে মাদক পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, খুন, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায় তারা। ২০০৯ সালের ২৮ এপ্রিল বাহিনীর প্রধান লালচাঁদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এরপর তাঁর ছোট ভাই সুকচাঁদ এ বাহিনীর দায়িত্ব নিলেও পরবর্তীতে সুকচাঁদ তার পরিবার নিয়ে ভারতে পালিয়ে অবস্থান নেয়। ছাপাত-পান্না বাহিনীর প্রধান ছাপাত ও পান্না দু’জনই ন্দুকযুদ্ধে নিহত। এরপর চরাঞ্চলে ফিরে আসে শান্তি। পরিণত হয় নিরাপদ জনপদে। দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে চরাঞ্চল। অস্ত্রের মহড়া ও ঝনঝনানিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে নিরীহ চরবাসী।
তবে লালচাঁদের ছেলে রুবেল হোসেন বলেন, লালচাঁদ বাহিনী নামে আর কোন বাহিনী নেই, অনেক লোক বাবার নাম ভাঙ্গিয়ে এইসব কর্ম করে বেড়াচ্ছে, আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানি না।
অপরদিকে চল্লিশ বাহিনী প্রধান রাখি বলেন, আমি জেল থেকে বের হয়ে ব্যবসা করি। বর্তমানে আমার চরের মধ্যে ১৮০ বিঘা কলার বাগান ও গরুর বাথান আছে এবং ঢাকাতেও আমার ব্যবসা আছে।
চরে যেগুলো ঘটছে এগুলো আমার নামে মিথ্যাচার করা হচ্ছে, আমি এসব সংগঠনের কিছুই জানি না। তবে লালচাঁদ বাহিনীর হয়ে কাজ করার জন্য আমাকে বলা হয়েছিল, আমি না করায় আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে আমার বিরুদ্ধে এরকম অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা। সন্ত্রাস নৈরাজ্য ও চাঁদবা জির বিষয়ে দৌলতপুর উপজেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুজ্জামান হাবলু মোল্লা বলেন, শুধু চরাঞ্চল নয় সারা দৌলতপুর সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের দখলে। কিছু নেতারা ছোট ছোট ছেলেদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, লুটপাট, ভাঙচুর করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, এমনকি মাঠের ফসল পর্যন্ত কেটে নিয়েছে। এরা মানুষের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের কাছে আমার অনুরোধ এসব ঘটনা খতিয়ে দেখে তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।
চরাঞ্চলের অস্থিতিশীল পরিবেশের বিষয়ে দৌলতপুর বিএনপি’র সদস্যসচিব শহীদ সরকার মঙ্গল বলেন, সন্ত্রাসীরা কারোর হয় না, বর্তমানে আমরা ফর্মে আছি তাই আমাদেরই বদনাম হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, পুলিশ প্রশাসন অনেকটাই দুর্বল, তাদের শক্ত ভূমিকা না থাকলে আমরা কি করতে পারি, তবে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী যে দলেরই হোক তাদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এসপি সাহেবের সাথে কথা হয়েছে তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।
এ বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য ও দৌলতপুর উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা স্থানীয় বলেন, সন্ত্রাসীরা কোন দলের হয় না। চরাঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে যারা তাদের চিহ্নিত করে আইনের হাতে তুলে দিতে যা করার তাই করবো। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এসব সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের কঠোর হাতে দমনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
দৌলতপুরে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের ঘটনার বিষয়ে দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজমুল হুদা বলেন, আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। সন্ত্রাসীদের নামের লিস্ট কালেকশন করেছি, তাদের ধরার জন্য আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। আপনারা জানেন ক’দিন আগে আমরা সাঈদ বাহিনীর প্রধান সাঈদকে গ্রেপ্তার করে চালান দিয়েছি। বাকিদের ধরার চেষ্টা করছি।
সাধারণ জনগণ চাই নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে বসবাস করতে। রাতে শান্তিতে ঘুমাতে এবং নিশ্চিন্তে ব্যবসা ও কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করতে। এজন্য প্রয়োজন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সহ রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা। আর এমনটাই মনে করেন সচেতন মহল।