থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত মুবাশ্বিরা ফেরদৌস মুশরা বাচতে চাই !

ফেসবুক থেকে নেওয়া : আসসালামুআলাইকুম। আশা করি আপনারা সবাই ভাল আছেন। ০২ অক্টবর ২০১৯ (সোমবার) ফের আমার শরীরে রক্ত দেয়া হলো। ২৪০ এমএল (O+) নতুন রক্ত। রক্ত নেয়া ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। রক্ত না নিলে আমি বাঁচবো না। তাই প্রতি মাসেই আমার রক্তের প্রয়োজন হয়। আজ আমি আমার এই ছোট্ট জীবনে রক্ত নেয়ার গল্পই আপনাদের শোনাবো। আমার নাম মুবাশ্বিরা ফেরদৌস মুশরা। বয়স পাঁচ বছর। ওজন ১২ কেজি। আমার শরীরে এখন আপনাদেরই দেয়া রক্ত বইছে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি আর আপনাদের সহযোগিতায় রক্ত নিয়েই আমি আজ বেঁছে আছি। আপনাদের রক্ত ছাড়া এই সুন্দর পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। হয়ত সারাজীবন আমাকে এভাবে আপনাদের রক্ত নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। না হয় ধীরে ধীরে একদিন এই পৃথিবী থেকে নিঃশ্বেষ হয়ে যেতে হবে। কারণ আমি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত একজন শিশু রোগী। আপনারা অবশ্যই জানেন এবং আমিও শুনেছি যে, থ্যালাসেমিয়া (ব্লাড ক্যান্সারই বলা চলে) একটি জন্মগত রোগ। দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের জিন বহন করছে। প্রতিবছর এই রোগ নিয়ে দেশে জন্ম নিচ্ছে অন্তত সাত হাজার শিশু। তাদের মধ্যে আমিও হতভাগ্য এক শিশু। থ্যালাসিমিয়া এমনই একটি রোগ যা রক্তের স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে বাঁধা দেয়, বা তৈরি হয় না। এ রোগীর পেটের প্লিহা ধীরে ধীরে বড় হয়ে যায়, তাকে ফ্যাকাশে দেখায়, ক্ষুদামন্দা হয় এবং রোগী এক পর্যায়ে রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। আবার শরীরে নুতন রক্ত দেয়া হলেও হিমোগ্লোবিন দ্রুত কমে যায়।

গত ৮ মে ২০১৯ তারিখ বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস উপলক্ষে ঢাকায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন ভবনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা থেকে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডাক্তার আমিনুল হাসানের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার আবুল কালাম আজাদ। বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ডাক্তার বেনজীর আহমদ, অধ্যাপক ডাক্তার এম এ খান, অধ্যাপক ডাক্তার মাজহারুল হক তপন প্রমুখ।আলোচনায় বক্তারা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সচেতনতার অভাব, অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং বাস্তবমুখী কার্যক্রমের অভাবে থ্যালাসেমিয়া দেশের স্বাস্থ্য সেবার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মত প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে তারা জনসচেতনা সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।এই আলোচনা থেকেই আমি থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেয়েছি।

এর আগে আমার রক্তশূন্যতা দেখা দিলে এবং দুর্বল হয়ে পড়লে তিন বছর বয়সে চিকিৎসকের পরামর্শে কুষ্টিয়ায় রক্ত পরীক্ষা করলে প্রথম থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। তখন আমার রক্তে হিমোগ্লোবিনের % ছিল মাত্র ৭.১। নর্মালভাবে যা থাকার কথা ১১.৫। সেসময় ডাক্তারের পরামর্শে তাৎক্ষণিকভাবে আমার শরীরে নতুন রক্ত দেয়া হয়। আমার রক্তের গ্রুপ ‘ও’ (+) পজেটিভ। পরে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক Pediatric Hematology & Oncology Department এর Associate Professor Dr.Zohora Jameela Khan কে দেখানো হয়।সেখানেও ইবনে সিনা ডায়াগনেষ্টিক এন্ড মেডিকেল সেন্টারের ব্লাড টেস্টে আমার Hb E-Beta Thalassaemic ধরা পড়ে।এরপর ওই চিকিৎসক আমাকে প্রতিদিন ১টি করে Folison খেতে এবং রক্তে হিমোগ্লোবিন ৯% এর নিচে এলেই রক্ত নেয়ার পরামর্শ দেন। সেই থেকে এ পর্যন্ত আমাকে ২০/২৫ দিন পর পরই শরীরে নতুন রক্ত নিতে হচ্ছে। কিন্তু এখন যে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তা হলো রক্ত দেয়ার জন্য ডোনার খুঁজে পাওয়া। অনেক সময় ডোনার খুঁজে না পাওয়ায় আমার শরীরে রক্ত নিতেও বিলম্ব হয়ে যায়। কিন্তু কি আর করার আছে। প্রায় দেড় বছরের ওপর আমি এভাবেই আপনাদের রক্ত নিচ্ছি। আর রক্ত চেয়ে আমি আপনাদেরকে বিরক্ত করছি। আমার আত্নীয় স্বজন ছাড়াও আমি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের কাছ থেকে সবচে বেশি রক্ত পেয়েছি। আর রক্ত সংগ্রহের এই কাজটি আমার বড় আব্বু ও বাবা-মা’ই করে থাকেন। নতুন নতুন ডোনার সংগ্রহ করা তাদের জন্যও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার একজন ডোনারের কাছে দ্বীতিয়বার রক্ত চাওয়াটাও বিবেকের কাছে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ এ পর্যন্ত যারা আমাকে রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

আমি রক্ত নেই ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে। তবে রক্ত নিতে এখানে বিড়ম্বনাও কম হয় না। এখানে যেসব সিসটার কাজ করেন তাদের বেশির ভাগই জুনিয়র ও শিক্ষনবিশ। আর সিনিয়র সিসটার যারা থাকেন তারা খুব প্রয়োজন না হলে রোগীর কাছে আসতে চান না। শিক্ষনবিশ এসব সিসটারের তেমন অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা ক্যানোলা লাগাতে গিয়ে হাতের রগ খুজে পেতে হয়রান হয়ে যান। তাই ক্যানোলা লাগাতে গিয়ে একবার ডান হাত, একবার বাম হাত, এমনকি পা পর্যন্ত ফুটা করে ফেলেন। এতে আমার ভিষন কষ্ট হয়। কান্নাকাটি করি। আবার বাবা-মা এ ব্যাপারে যদি তাদেরকে কিছু বলেন, তাতে তারা মাইন্ড করেন। মাঝে মধ্যেই আমাকে এই ধরণের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয়।এটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়। আমার মতো সব শিশুদের ক্ষেত্রেই এমনটি হচ্ছে। শুধু মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া কোন উপায় নেই। আমরা বড় অসহায় হাসপাতলে চিকিৎসা নিতে এসে। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মতো একটি বড় সরকারী প্রতিষ্ঠান। অথচ শিক্ষনবিশ সিসটার আর ইন্টানী ডাক্তার দিয়েই চালানো হচ্ছে পুরো হাসপাতাল। বড় ডাক্তারের পরামর্শ পাওয়া এখানে ভাগ্যের ব্যাপার। তাছাড়া ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন রোগী থাকে অন্তত ৭/৮শ। এটাও হাসপাতালের জন্য একটা বড় সমস্যা। তাই প্রতিদিনই এখানে থাকছে রোগীর প্রচন্ড চাপ।অবস্থা এমন যে, রোগী ও তাদের স্বজনদের ভীড়ে হাসপাতালে পা রাখারও জায়গা থাকে না।

যাইহোক আমি ভিন্ন কথায় চলে গিয়েছিলাম। আমার কথায় ফিরে আসি।রক্ত নিতে হাসপাতালে ভর্তি হলে প্রতিবারই অন্তত ৮/১০ জন থ্যালাসেমিয়া শিশু রোগীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। যাদের বয়স দেড় থেকে ১০/১২ বছর পর্যন্ত। এসব থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়ে সরকারের কোন চিন্তাভাবনা, এর সহজসাধ্য চিকিৎসাসেবা কিংবা সহযোগিতা আছে কি-না তা আমার জানা নেই। আপনাদের জানা থাকলে সেটা আমাকে জানালে উপকৃত হব। শুনেছি এই রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। তাই অনেক দরিদ্র রোগীর আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় এক সময় তারা অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। হয়ত তাদের মতো একদিন আমিও অকালে ঝরে যাব। কারণ আমার বাবার আর্থিক সামর্থ তেমন নেই। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, এই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে যতদিন রোগী বাঁচবে, ততদিন নিয়মিত নতুন রক্ত গ্রহণ করতে হবে কিংবা বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করতে হবে। কিন্তু এই বোনম্যারো প্রতিস্থাপন অত্যন্ত ব্যয়বহুল এক চিকিৎসা। অন্তত কোটি টাকার ব্যাপার। যা আমার পরিবারের জন্য আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না।

আমি আর সব শিশুদের মতোই সুস্থ্য ও স্বাভাবিক শরীর নিয়ে আপনাদের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই।তাই আপনারা ছোট্ট এই মুশরার জন্য দোয়া করবেন। আর কিভাবে আমি রক্তের জন্য ডোনার পেতে পারি, দেশে এই রোগের সহজসাধ্য চিকিৎসাসেবা কোথাও আছে কি-না এবং কীভাবে আমি ভাল ও সুস্থ্য থাকতে পারি- এসব বিষয়ে আপনাদের পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।
যোগাযোগ ~
এমএ রকিব ~01711236313

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *