অনলাইন ডেস্ক :
নিখোঁজের একদিন পর মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদী থেকে দৈনিক আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের (৭১) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার বিকাল ৩টার দিকে গজারিয়ার চরবলাকী এলাকার মেঘনা নদীতে ভাসমান অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করে কলাগাছিয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা।
অফিসে যাওয়ার কথা বলে বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে বের হন তিনি। ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন ও ট্যাব বাসায় রেখে যান। বিকাল পাঁচটার মধ্যে তার বাসায় ফেরার কথা ছিল। পরে রাত ৯টায়ও বাসায় না ফেরায় অফিসে যোগাযোগ করে ছেলে জানতে পারেন যে তিনি (বিভুরঞ্জন) অফিসে যাননি। এর পর বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তার কোনো তথ্য না পাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাতে রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ছেলে ঋত সরকার।
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত কলাম লিখতেন। তিনি কর্মস্থল আজকের পত্রিকা থেকে গত ১৬ আগস্ট থেকে সাত দিনের ছুটিতে ছিলেন। তার লেখা সর্বশেষ নিবন্ধটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মেইল করেন বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৯টায়।
ফুটনোটে তিনি লেখেন, ‘জীবনের শেষলেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন।’ গতকাল শুক্রবার তার সেই নিবন্ধটি বিডিনিউজে প্রকাশ হয়। ‘খোলা চিঠি’ শিরোনামে সেই লেখায় তিনি নিজের ও ছেলের অসুস্থতা, মেডিক্যাল পাস সরকারি কর্মকর্তা মেয়ের উচ্চতর পরীক্ষায় ‘ফেল করা’, বুয়েট থেকে পাস করা ছেলের ‘চাকরি না হওয়া’ এবং নিজের আর্থিক দৈন্যদশা নিয়ে হতাশার কথা লেখেন।
মুন্সীগঞ্জের কলাগাছিয়া নৌফাঁড়ির ইনচার্জ মো. সালেহ আহমেদ পাঠান বলেন, শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে খবর পেয়ে বিকাল ৩টার দিকে গজারিয়ার চরবলাকী এলাকার মেঘনা নদীতে ভাসমান অবস্থায় লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, উদ্ধারের সময় সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরিকালে তার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মরদেহটি উপুড় হয়ে নদীতে ভাসছিল। গলায় তার চশমা ঝুলছিল। এর পর সাংবাদিকদের দেখানো ছবির সঙ্গে মরদেহের চেহারায় মিল পাওয়া যাওয়ায় বিষয়টি ঢাকার রমনা থানা পুলিশকে জানানো হয়। রমনা থানা পুলিশ তার পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে পরিবারের সদস্যরা মর্গে এসে বিভুরঞ্জনের লাশটি শনাক্ত করেন।
ছেলে ঋত সরকার বৃহস্পতিবার রাতে রমনা থানায় যে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তাতে লেখেন, প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার জন্য রওনা করেন তার বাবা বিভুরঞ্জন। কিন্তু এর পর আর বাসায় ফেরেননি। রাত ৯টায় আজকের পত্রিকায় যোগাযোগ করে জানতে পারেন তার বাবা অফিসে যাননি।
লাশ উদ্ধারের ঘটনায় চরবলাকী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘শুক্রবার বাসা থেকে জুমার নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম। পথে দেখলাম মেঘনা নদী থেকে আমাদের বাজারের দিকে যাওয়ার খালে এক ব্যক্তির লাশ ভাসছে। লাশটি উল্টো হয়েছিল। নামাজ পড়ে এসে দেখি উৎসুখ জনতার ভিড় জমে গেছে। পরে আমরা বিষয়টি পুলিশকে জানাই।
গতকাল বিকালে মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশ বিভুরঞ্জনের মরদেহ উদ্ধারের পর রমনা থানা পুলিশকে জানায়। পরে রমনা থানা পুলিশ জিডির সঙ্গে সংযুক্ত বিভুরঞ্জনের ছবিটি মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশকে দেন। তারা পরে মিলিয়ে দেখেন উদ্ধার হওয়া মরদেহটি সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের। পরে খবর পেয়ে বিভুরঞ্জনের ভাই চিররঞ্জন সরকারসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য মুন্সীগঞ্জের পথে রওনা হন। পরে তারা মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন।
বিভুরঞ্জনের ছোট ভাই চিররঞ্জন সরকার বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুকে লেখেন, আমার দাদা সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় অন্যান্য দিনের মতো অফিস (আজকের পত্রিকা) যাবে বলে বাসা থেকে বের হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সে অফিসে যায়নি। পরিচিত পরিম-লের কোথাও যায়নি। আজ কেউ তাকে দেখেনি। রাত ১টা পর্যন্ত সে বাসায় ফেরেনি। হাসপাতাল-পার্ক কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে আজ মোবাইলও বাসায় রেখে গেছে। রাতে রমনা থানায় জিডি করা হয়েছে। তার জন্য আমরা পরিবারের সবাই ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে আছি।
রাতে চিররঞ্জন সরকার আমাদের সময়কে বলেন, আজ (শুক্রবার) বিকালে রমনা থানার ওসির মাধ্যমে জানতে পাড়ি মেঘনা নদী থেকে একজনের লাশ পাওয়া গেছে। পরে ছবি দেখেই আমরা সন্দেহ করেছিলাম এটা দাদার লাশ হতে পারে। এখন আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি এটা দাদারই লাশ। এমন ঘটনা কীভাবে ঘটল, এটা আত্মহত্যা না কি খুন, না পূর্বপরিকল্পিত- আমরা কিছুই জানি না। শুধু এটাই বলব, এমন পরিণতি যাতে কারও না হয়।
ছেলে ঋত সরকার বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে মাকে বলে গিয়েছিলেন বিকাল ৫টায় বাড়ি ফিরবেন। প্রতিদিন বিকালের দিকেই বাড়ি ফেরেন। বাবা এদিন ফোন বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন। তিনি মাঝে মধ্যে এভাবে বাড়িতে ফোন রেখে যেতেন। আর খোলা চিঠির ব্যাপারে আজই জানতে পেরেছি।
১৯৫৪ সালে পঞ্চগড়ে জন্ম নেওয়া বিভুরঞ্জন সরকার ষাটের দশকের শেষদিকে স্কুলে পড়ার সময় দৈনিক আজাদে মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে লেখাপড়া করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিকে তিনি কাজ করেছেন। দৈনিক মাতৃভূমি, সাপ্তাহিক চলতিপত্রের সম্পাদক এবং সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।বিভুরঞ্জন স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় বসবাস করতেন।

