নাটের গুরু অমিত সাহা।

ন্যাশনাল ডেস্ক : বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখান ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহা। পরে তিনি আরও কয়েক ছাত্রলীগ নেতাকে স্ট্যাটাসটি দেখান। একইসঙ্গে তিনিই আবরারকে শিবির হিসেবে প্রচারণা চালান।

স্ট্যাটাস দেওয়ার পরদিন (গত রবিবার) দুপুর থেকে আবরার হলে ফিরেছে কিনা খোঁজ নেন অমিত সাহা ও মেহেদী হাসান রবিনসহ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা।

এ নিয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের সিক্রেট মেসেঞ্জার গ্রুপে খুনিদের কথোপকথন হয়। যেখানে ফাহাদকে পিটিয়ে হলছাড়া করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আর রবিবার শেষ বিকালে বাড়ি থেকে ফেরার পর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ২০১১ ও ২০০৫ নম্বর কক্ষে আবরার ফাহাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতনের নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা ইফতি মোশররফ সকাল, অনিক সরকার ও মেহেদী হাসান রবিন। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে অনিক ও সকাল আবরার ফাহাদকে পেটাতে পেটাতে ক্রিকেট স্টাম্প ভেঙে ফেলেন। ঘটনার রাতে অমিত, সকাল ও অনিকসহ অন্তত তিনজন মদ্যপ ছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়।

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েট ক্যাম্পাসে আলোচনার শীর্ষে থাকা বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ১৬তম ব্যাচের ছাত্র অমিত সাহা ও ফাহাদের এক সহপাঠীসহ আরও তিনজনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সুবজবাগ এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার রাতে এক পর্যায়ে দুর্গাপূজা মণ্ডপে ঘুরতে যান অমিত। সেখানে থেকে মদ্যপ হয়ে হলে ফিরে আসেন বলে সূত্র জানায়। ডিবি সূত্র জানায়, গ্রেফতার ইফতি মোশাররফ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইফতি মোশররফ আদালতে এই স্বীকারোক্তি দেন। অন্যরাও হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তাদের দাবি হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত ছিল না। তারাও আদালতেও স্বীকারোক্তি দিতে পারেন।

একই সূত্র মতে, রবিবার রাতে বুয়েট শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ সরিয়ে ফেলতে ডাক্তার মাসুক এলাহী ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানকে চাপ দেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল। কিন্তু খুনের বিষয়টি পুলিশ কেস হওয়ায় তারা তাতে রাজি হননি। সে কারণে লাশ সরিয়ে ফেলার চেষ্টা সফল হয়নি। ফাহাদের ওপর হামলাকারীরা ছাত্রলীগ নেতা রাসেলের অনুসারী।

এদিকে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুলিশ আদালতে দাখিল করবে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। অন্যদিকে পুলিশের নিষ্ঠার কারণেই ফাহাদ হত্যার আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে মন্তব্য করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঘটনার মোটিভ সম্পর্কে জানতে আমাদের আরও কয়েকদিন সময় লাগবে। বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড অনেকগুলো ঘটনার সমষ্টি। একটিমাত্র কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা এখনই বলা যাবে না।

ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, নতুন করে গ্রেফতারকৃতরা হলেন, ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহা, নিহতের রুমমেট মিজানুর রহমান ও এজাহারভুক্ত আসামি হোসেন মো. তোহা। এর মধ্যে এজাহারবহির্ভূত গ্রেফতার ৩ জন হলো অমিত সাহা, মিজানুর রহমান ও শামসুল আরেফীন রাফা। ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া স্ট্যাটাস বা শিবির সন্দেহে আবরার ফাহাদকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে কিনা। এর জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি অনেক ঘটনার কারণের মধ্যে একটি কারণ হতে পারে। এটিই একমাত্র কারণ কিনা, তা এখনই বলা যাবে না। আরো কারণ থাকতে পারে।

অমিত সাহার ব্যাপারে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, একজন মানুষ ঘটনাস্থলে থেকেও ঘটনা সংঘটিত করতে পারে, আবার দেখা যায় ঘটনাস্থলে না থেকেও করতে পারে। প্রাথমিক তদন্তে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, অমিত সাহা ঘটনাস্থলে ছিল না। তবে এই ঘটনায় তার দায়-দায়িত্ব রয়েছে। তদন্তে সম্পৃক্ততা পাওয়ার কারণেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, পুলিশের কাছে আসামিদের দেয়া জবানবন্দি বলছে, আবরার ফাহাদকে ঘটনার রাতে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে দফায় দফায় পেটানো হয়। টানা প্রায় ৬ ঘণ্টা চলে এ নির্যাতন। নির্যাতনের একপর্যায়ে ঘাতকরা তার কাছে জানতে চায়, বুয়েটে কারা কারা শিবির করে। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে ফাহাদ কয়েকজনের নাম বলেন। ছাত্রলীগ নেতারা তার দেয়া নামগুলোর তথ্য যাচাই করে। এতে দেখা যায়, তাদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এরপর আবরার ফাহাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। ছাত্রলীগ নেতা অনিক সরকার ও ইফতি মোশররফ সকাল পেটাতে পেটাতে ভেঙে ফেলে ক্রিকেট স্টাম্প। রোবাবার রাত ৮টা থেকে সোয়া ১টা পর্যন্ত বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০১১ ও ২০০৫ নম্বর রুমে দফায় দফায় ফাহাদের ওপর এভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতন চলে। এরপর রাত আড়াইটার পর তার নিস্তেজ দেহ নিয়ে ছোটাছুটি করেন ঘাতকরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *