অনলাইন ডেস্ক: জুন মাসের প্রচণ্ড গরমে ফিরোজা ষষ্ঠ সন্তানের মা হন। ফিরোজার কর্মস্থলের মালিক সুশানের একমাত্র ছেলে থমসন নিজের কেনা বাড়ি থেকেই নিজস্ব গাড়িতে কাজে যায়। তার দেশে সবাই শিক্ষিত।
ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের জনসংখ্যা বিষয়ক অধ্যায়ের একটি অনুচ্ছেদ এটি।
এ অনুচ্ছেদটি পড়ে শিক্ষার্থীদের জলবায়ু, শিক্ষার হার, সমাজ ব্যবস্থা ও সামাজিক গতিশীলতার মধ্যে ফিরোজার ক্ষেত্রে জন্মহার তারতম্যের কোন কারণটি প্রযোজ্য তার উত্তর দিতে হবে। একই সঙ্গে থমসনের দেশের ক্ষেত্রে ‘জন্মহার বেশি হবে, সুচিকিৎসার অভাব, জন্মহার কম হবে এবং খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব’ এই চারটির মধ্যে কোন প্রভাবটি পরিলক্ষিত হতে পারে তা বলতে বলা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ২০১৯ নতুন শিক্ষাবর্ষে এই বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়েছে। ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরাও ফিরোজার সন্তান জন্মদানের অনুচ্ছেদ পড়েছে।
ফিরোজার সন্তান জন্মদানের এ অংশটুকু কয়েকবার পড়ার পর সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার বললেন,‘নাহ, আমিও এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।’
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরীও বলেন,‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি, কিন্তু তারপরও তো এ অনুচ্ছেদটি আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। বাচ্চাদের কাছে কেমনে বোধগম্য হবে?’
ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে। পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করা হয় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। গত বছরের জুলাই মাসে বইটির পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে।
এ বইটির সম্পাদনায় ছিলেন অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক শফিউল আলম, আবুল মোমেন, অধ্যাপক ড. মাহবুব সাদিক, অধ্যাপক ড. মোরশেদ শফিউল হাসান, অধ্যাপক ড. সৈয়দ আজিজুল হক এবং সৈয়দ মাহফুজ আলী।
বইটির সম্পাদনা বিভাগে নাম থাকা শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন,‘আমরা পাঠ্যপুস্তক নিয়ে কাজ করেছিলাম অনেক আগে। ফিরোজার ষষ্ঠ সন্তান জন্মদানের যে অনুচ্ছেদ তখন সে ধরনের কিছু ছিল না বলেই মনে হচ্ছে। আর এই যুগে ফিরোজা কেনই বা ষষ্ঠ সন্তানের জন্ম দেবেন?’আবুল মোমেন বলেন,‘পাঠ্যপুস্তকটির সম্পাদনায় যেহেতু আমার বা আমাদের নাম আছে, খুব শিগগিরই এনসিটিবির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে পাঠ্যপুস্তকগুলো রিভিউ করার আবেদন জানাব।’
তৃতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের জনসংখ্যা বিষয়ক অধ্যায়টি পড়তে হচ্ছে। অধ্যায়গুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফিরোজার সন্তান জন্মদানের মতো এ ধরনের নানান অসংগতি, তথ্য ও বাক্যগত ভুল বা তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত করা হয়েছে অধ্যায়গুলো।
এনসিটিবি প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জনের জন্য শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসারে পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য শিখন উপকরণের উন্নয়ন ও পরিমার্জনের কাজ করে থাকে এ প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলা মাধ্যমের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তান পড়ুয়া একাধিক অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেছেন, তৃতীয় শ্রেণি থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল শেখানো শুরু হয়েছে। এ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আদমশুমারি, নারী-পুরুষের শতকরা অনুপাত, জনসংখ্যার ঘনত্ব মুখস্থ করতে হচ্ছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার বলেন,‘আমরা জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়েই জনমিতি, জন্মহার, মৃত্যুহারসহ বিভিন্ন বিষয় বুঝতে হিমশিম খাই, আর বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের এই সব তত্ত্ব পড়ানো হচ্ছে শিশুদের। বিষয়গুলো তাদের মেধা ও বয়সের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়নি।’
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বলছে,এনসিটিবি তাদের সঙ্গে ২০১০ সালের আগে একবার যোগাযোগ করলেও তারপরে আর যোগাযোগ করেনি। এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বলছে, বইগুলো দেখার জন্য একাধিক সম্পাদক থাকেন। তবে বইগুলোতে সম্পাদনা হিসেবে যাঁদের নাম আছে তাঁদের মধ্যে কয়েকজন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, পাঠ্যবইতে এনসিটিবি পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন করলে তা আর তাঁদের দেখানো হয় না।
বয়সের তুলনায় বেশি কঠিন: ৯ থেকে ১০ বছর বয়সী চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জনসংখ্যা অধ্যায় থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় এবং স্বাস্থ্যগত কারণগুলোর তালিকা তৈরি করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করতে টেলিভিশনে একটি নতুন ধরনের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করতে হবে। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথি কারা, কী কী দৃশ্য থাকতে পারে এবং কী বার্তা দিতে চায় তাও বলতে হবে। একই সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গ্রাফ, ১৯৭৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা কত ছিল ইত্যাদি তথ্যও জানতে হবে।
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সমাজের ওপর অধিক জনসংখ্যার প্রভাব পড়তে পড়তেই একই ক্লাসে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করার কথা শিখবে। ‘এসো বলি’ শিরোনামে শিক্ষার্থীদের কাগজকলের জন্য কী ধরনের মূলধন, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানবসম্পদ দরকার তা বর্ণনা করতে বলা হয়েছে। এই শিক্ষার্থীদের আমরা কীভাবে আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধিতে মানবসম্পদকে ব্যবহার করতে পারি?-এ প্রশ্নের অল্প কথায় উত্তর দিতে হবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে চলাচলের ক্ষেত্রে রাস্তাঘাটে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়। একজন পরিকল্পনাকারী হিসেবে রেলপথ, বাসযাত্রী, গাড়ি চালক এবং পথচারীর মতো বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীর পরিকল্পনা কী তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দি চিলড্রেনের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, জনসংখ্যা দেশের জন্য বড় একটি সমস্যা। শিক্ষার্থীদের তা নিয়ে শেখাতে হবে। তবে শিশুর মনস্তত্ত্ব বুঝে সেই তথ্য দিতে হবে। কিন্তু জনসংখ্যা বিষয়ক অধ্যায়গুলোতে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে তা শিশুদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, প্রথমত তৃতীয় শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের জনসংখ্যার মতো গুরুগম্ভীর একটি বিষয় পড়ানোর দরকার আছে কি না তা নির্ধারণ করতে হবে। আর পাঠ্যপুস্তকে পরিমার্জনের কথা দীর্ঘদিন ধরে শোনা গেলেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। শিশুদের হাতে বই তুলে দেওয়ার আগে বইতে আসলে কী থাকছে বা প্রক্রিয়াগত গলদ আছে কি না তা দেখভাল করার কেউ নেই।