নতুন সড়ক পরিবহন আইনে সাজার সঙ্গে বাড়ছে চ্যালেঞ্জ

ন্যাশনাল ডেস্ক : সড়কে আইন ভঙ্গে সাজা বাড়ছে কয়েকগুণ। আজ ১ নভেম্বর কার্যকর হচ্ছে বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। পরিবহন খাতের বিভিন্ন পক্ষ বলছেন, বিধিমালা প্রণয়ন এবং প্রস্তুতি ও প্রচার ছাড়াই আইনটি কার্যকর হওয়ায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এটা বাস্তবায়নেও চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে সংশ্নিষ্টদের। জেল-জরিমানা বেড়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়তে পারেন মালিক, চালক ও যাত্রীরা। আইনটি নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো উচিত ছিল।

তবে বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি একটি বহুল আলোচিত আইন। ২০১০ সাল থেকে এ নিয়ে কথা চলছে। দফায় দফায় সব পক্ষের মতামত নেওয়া হয়েছে আইন প্রণয়নে।

এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সমকালকে বলেন, ‘আইন কার্যকর হওয়ার পর এর ফলাফল তথা আইনের প্রায়োগিক বাস্তবতা জনস্বার্থে কতটা কাজে লাগছে, তা বোঝা যাবে। তবে এই আইনে অনেক কিছুই রয়েছে, যার বাস্তবায়ন হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।’

অন্যদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান বলেছেন, ‘চালক বা শ্রমিককে সাজা বা ফাঁসি দিলে দুর্ঘটনা বন্ধ হবে, এমন অলীক কল্পনা যারা করেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।’ সড়ক পরিবহন আইনের সব মামলা জামিনযোগ্য করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য, এ আইনে সড়কে বেপরোয়া গাড়ির কারণে কারও মৃত্যু হলে চালককে পাঁচ বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। দিতে হবে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা প্রমাণ হলে ৩০২ ধারায় মামলা করা যাবে।

পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও প্রচার ছাড়াই আইন কার্যকরের অভিযোগ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান ড. মো. কামরুল আহসান বলেন, ‘এ আইনের উদ্দেশ্য ঢালাও সাজা দেওয়া নয়, সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। তা ধীরে ধীরে কেটে যাবে।’

গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বেপরোয়া বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হন। এ ঘটনার বিচারের দাবিতে সারাদেশে রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে একই বছরের ৫ আগস্ট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায় আট বছর ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইন। সেপ্টেম্বরে সংসদে পাসের পর গত ৮ অক্টোবর তা গেজেট আকারে প্রকাশ পায়। এর এক বছর পর আজ কার্যকর হচ্ছে আইনটি।

নতুন আইন কার্যকরের মাধ্যমে রহিত হয়ে যাচ্ছে মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩। নতুন আইনে সড়কে নিয়ম ভঙ্গে সাজা বেড়েছে বহুগুণ। অধ্যাদেশে বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। নতুন আইনে সর্বোচ্চ জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা এবং ছয় মাসের কারাদণ্ড। ভুয়া লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশনে গাড়ি চালানোর সাজা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা বা দুই বছর জেল অথবা উভয় দণ্ড। অধ্যাদেশে রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ি চালানোর সাজা ছিল সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা জরিমানা ও তিন মাস কারাদণ্ড। ফিটনেসবিহীন গাড়ির ক্ষেত্রে একই পরিমাণ সাজা ভোগ করতে হতো। নতুন আইনে রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ছয় মাস জেলের বিধান রয়েছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানোর সাজা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা।

আইনের অধিকাংশ ধারায় সর্বোচ্চ সাজার কথা বলা থাকলে সর্বনিম্ন সাজার উল্লেখ নেই। বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. ইউছুব আলী মোল্লা বলেছেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা পরিস্থিতি ও অপরাধ বিবেচনা করে জরিমানা নির্ধারণ করবেন। তবে তা সর্বোচ্চ নির্ধারিত জরিমানার চেয়ে বেশি হবে না। বিধিমালায় এসব বিস্তারিত থাকবে।

সড়ক পরিবহন আইন তফসিলভুক্ত করতে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। আজ থেকে আইনটি কার্যকর হলেও এখনও বিধিমালা হয়নি। এভাবে আইন কার্যকর করায় প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সরকার আইনটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। প্রশ্ন হলো, বিধিমালা প্রণয়ন ছাড়াই আইন প্রয়োগে জটিলতার অবসান হবে কীভাবে?’

বিআরটিএর পরিচালক এবং বিধিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য মাহবুব-ই রাব্বানী বলেছেন, ‘যতদিন বিধিমালা না হবে, ততদিন মোটরযান বিধি-১৯৮৪ কার্যকর থাকবে।’ কবে বিধিমালা প্রণয়ন শেষ হবে, তা নিশ্চিত করে বলেননি তিনি।

নতুন আইনে বর্ধিত জেল-জরিমানা প্রসঙ্গে মাহবুব-ই রাব্বানী বলেন, সব আইনেই সর্বোচ্চ জরিমানা ও শাস্তির কথা বলা থাকে। বিচারক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্নেষণ করে সর্বোচ্চ বা তার চেয়ে কম সাজা দেন। বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালালে ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও, এর চেয়ে কম জরিমানা করা যাবে।

গত বছর পাস হলেও আইনটি শিথিলে ‘সংশোধনী প্রস্তাব’ দিয়েছিল পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। অভিযোগ রয়েছে, তাদের বাধাতেই গত আট বছর এ আইন করা যায়নি। এ প্রসঙ্গে শাজাহান খান বলেছেন, শুধু শাস্তির ভয় দেখিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা আনা যাবে না। শৃঙ্খলা আনতে তার নেতৃত্বাধীন কমিটির ১১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।

নতুন আইনে ট্রাফিক সংকেত ভঙ্গে জরিমানা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। উল্টোপথে গাড়ি চালালে একই পরিমাণ জরিমানা দিতে হবে। হেলমেট না থাকলে এখন জরিমানা ২০০ টাকা। নতুন আইনে জরিমানা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। গাড়ি চালানোর সময় সিল্টবেল্ট না বাঁধলে, মোবাইলে কথা বললে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করলে তিন লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে চালককে। তিন বছর পর্যন্ত জেলও হতে পারে।

নতুন আইনে চালকদের লাইসেন্স পেতে অষ্টম শ্রেণি পাস করতে হবে। চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাস হতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে ১২ পয়েন্ট রাখা হয়েছে। সড়কে আইন ভঙ্গে জেল-জরিমানা ছাড়াও লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা যাবে। পুরো ১২ পয়েন্ট কাটা গেলে লাইসেন্স বাতিল হবে। চালক ও তার সহকারীকে নিয়োগপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

গাড়িতে অতিরিক্ত পণ্য বহন করলে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা বা এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে মালিককে। তবে শাজাহান খান গতকাল দাবি করেছেন, তাদের দাবি অনুযায়ী লোডিং পয়েন্টে ওভারলোড পরীক্ষা করতে হবে।

আইনের ৮৪ ধারায় গাড়ির আকৃতি পরিবর্তনে তিন বছর কারাদণ্ড বা এক থেকে তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ৮৪ ধারা ছাড়াও বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে আহত করা (৯৮ ধারা), সড়কে মৃত্যুর (১০৫ ধারা) মামলা জামিন অযোগ্য করা হয়েছে এ আইনে। তবে সব ধারার মামলা জামিনযোগ্য করার দাবি জানিয়েছেন শাজাহান খান।

এ দিকে এ আইন সম্পর্কে সচেতনতা অভিযান চালাতে আজ থেকে মাঠে নামছে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বাধীন নিরাপদ সড়ক চাই ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *