ট্রেন চালানো নিয়ে লোকো মাস্টার ও সহকারী একে অপরের দায় চাপালেন

ন্যাশনাল ডেস্ক : ঢাকাগামী তূর্ণা নিশিতা ট্রেনের লোকো মাস্টার (এলএম) তাছের উদ্দিন। তিনি ট্রেন চালিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা শুরু করলেন। তার সাথে ছিলেন সহকারী লোকো মাস্টার (এএলএম) অপু দে। তাদের সাথে ছিলেন গার্ড আবদুর রহমানও। এরপর তূর্ণা নিশিতা এক্সপ্রেসের আউটার এবং হোম সিগন্যালে লাল বাতি (সর্তক সংকেত) দেয়া হলেও মঙ্গলবার ভোর রাতে কসবার মন্দবাগ রেলস্টেশনে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এতে ১৬ জন নিহতের পাশাপাশি শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ট্রেন চালকের ঘুম এবং দায়িত্বহীনতার কারণেই এ দুর্ঘটনাটি ঘটে।

তবে লোকো মাস্টার (এলএম) নাকি সহকারী লোকো মাস্টার (এএলএম) ট্রেন চালাচ্ছেন সেটি সঠিক করে কেউ বলছেন না। এটি নিয়ে একে অপরের দায় দিচ্ছেন। তাদের দুইজনের সঙ্গে মঙ্গলবার সকালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বেশে কথা হলে এমনটাই বলেন তারা। ইতিমধ্যে উক্ত অভিযুক্ত তিনজনকেই সাময়িক বরখাস্ত করেছে রেলওয়ে প্রশাসন। তারা বর্তমানে পলাতক আছেন। তাদের গ্রেপ্তারে কাজ করছেন প্রশাসন। তাছাড়া এই ঘটনায় পৃথকভাবে পাচঁটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে। এর মধ্যে বাংলা‌দেশ রেলও‌য়ের ২টি, রেলপথ মন্ত্রণাল‌য়ের ১টি, সরকা‌রি রেলপ‌রিদর্শক ১‌টি, জেলা প্রশাসন ১টি। এসব কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত দাখিলের নির্দেশনাও দিয়েছে রেলওয়ে। তবে, পরে অভিযুক্ত তূর্ণা নিশিতা ট্রেনের এলএম তাছের উদ্দিন ও সহকারি এলএম অপু দে’কে ফোন করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়া পরই ফোন কেটে দিয়ে বন্ধ করে দেন।
এর আগে, মঙ্গলবার ভোর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অভিমুখী ‘তুর্ণা নিশিথা’র সঙ্গে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা করা ‘উদয়ন এক্সপ্রেস’ ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় সর্বশেষ খবর পর্যন্ত ১৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক যাত্রী।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রেল সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সকর্ত সংকেত দেয়া সত্ত্বেও ট্রেন চালকের দায়িত্বহীনতার কারণে (ট্রেন চালানোর সময় ঘুম ও অসচেতনতা) দেশের এতো বড় একটি দূুর্ঘটনা ঘটেছে। যা রেলের জন্য অনেক ক্ষতি হয়েছে। এক্ষেত্রে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অবহেলার বিষয়টাও তুলছেন তারা।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল আহমেদ বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনার বিষয়ে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ তদন্ত প্রতিবেদন পেলেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া অভিযুক্ত চালক, গার্ডরা বর্তমানে পলাতক রয়েছে। তাদেরকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায়ও আনা হবে বলে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) ইঞ্জিনিয়ার বোরহান উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আউটার ও হোম সিগন্যালে লাল বাতি (সর্তক সংকেত) দেওয়া ছিল। কিন্তু তূর্ণার নিশীতার চালক সিগন্যাল অমান্য করে ঢুকে পড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। পৃথক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দ্রুত দাখিল করতেও নির্দেশনা রয়েছে। তবে কি কারণে এতো বড় দুর্ঘটনা তা তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার আগেই নিদিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। চালক ঘুমাচ্ছেন নাকি অন্য কোন সমস্যা সেটি তদন্ত রিপোর্ট পেলেই বলা যাবে বলে জানান তিনি।

রেলওয়ের উচ্চ পর্যায়ের গঠিত কমিটির অনত্যম সদস্য ও পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী (সিই) মো. সুবক্তগীন বলেন, এই দুর্ঘটনা নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেটির তদন্ত প্রতিবেদন নিরপেক্ষতার মধ্যে থেকেই দ্রুত সময়ের মধ্যে দাখিল করতে বলা হয়েছে। সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই দ্রুত এ প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলেও জানান তিনি।

মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে সংঘটিত দুর্ঘটনার বিষয়ে পৃথক পাচঁটি তদন্ত কমিটি করেছে রেলওয়ে। এর মধ্যে রেলওয়ের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রেলওয়ের বিভাগীয় প্রধান পর্যায়ের কর্মকর্তাগণের সমন্বয়ে ৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন আহবায়ক হচ্ছেন চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পূর্ব) মো. নাজমুল ইসলাম, সদস্যরা হলেন চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্ব) মো. মিজানুর রহমান, প্রধান প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন, চিফ সিগন্যাল এন্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার অসীম কুমার তালুকদার।

বিভাগীয় কর্মকর্তাগণের সমন্বয়ে গঠিত ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সদস্যরা হলেন তদন্ত কমিটির আহবায়ক ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় ট্রান্সপোর্ট অফিসার মো. নাসির উদ্দিন, সদস্যরা হলেন বিভাগীয় সিগন্যাল এন্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার মো. জাহিদ আরেফিন তন্ময়, চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ মো. হামিদুর রহমান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার/ লোকো, ফয়েজ আহম্মদ খাঁন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় মেডিক্যাল অফিসার ফাতেমা বেগম। এ কমিটি আগামী দুই দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় ৪ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির আহবায়ক হচ্ছেন রফিকুল ইসলাম রেলপথ মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত আইন সচিব (আইন ও ভূমি) মো. রফিকুল ইসলাম, সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ মু. আবুল কালাম, যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন) রাশিদা সুলতানা গনি, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মীর আলমগীর হোসেন। আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। তাছাড়া রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারী রেলপথ পরিদর্শক নিজে পরিদর্শন করে মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করবেন এবং জেলা প্রশাসক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পক্ষ থেকে আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অন্যদিকে, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এমপি হতাহতের বিষয়ে গভীরভাবে শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি শোক সন্তুপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জানিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *