সালমান শাহেদ:-“সদেশের মাঝে একটায় দেশ কুষ্টিয়া ,তারই মাঝে কাটাবো বাকি জীবনটা ”। কথাটি বলেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায়। এমন কথা শুধু তারই নয় অনেক কবি সাহিত্যিক লেখক ও মনীসিরা বলেছেন। প্রাচীন জনপদ কুষ্টিয়ার মাটি ও মানুষকে ঘিরে নানান কথা গল্প লিখেছেন তারা। প্রাচীন ঐতিহ্য পদ্মা গড়াই বিধৌত কুষ্টিয়ার বিস্তৃর্ণ জনপদ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাকোর ঠাকুর বংশে জন্মগ্রহণ করেও এই কুষ্টিয়ার মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। ১৮৬১ সালের ৭ মে জন্মগ্রহণ করে ৭ এ আগষ্ট ১৯৪১ সাল পর্যন্ত। জীবনের বেশির ভাগ সময় কুষ্টিয়াতেই কাটিয়েছেন। মরমী কবি বাউল স¤্রাট ফকির লালন শাহ্ ১৭৭২ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে এই কুষ্টিয়াতে ১৭ অক্টবর ১৮৯০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত কালিগঙ্গার পাড় ছেউড়িয়ায় মৃত্যু বরণ করেন। সুসাহিত্যিক মীর-মোশারফ হোসেন ১৩ নভেম্বর ১৮৪৭ সালে কুষ্টিয়াতে জন্মগ্রহণ করে জীবনের সুখ নিয়েছেন। ১৯১২ সালে তিনি কুষ্টিয়ার মায়া ত্যাগ করে ইন্তেকাল করেন। সাংবাদিকতার প্রত্রিকৃত কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার তিনিও ১৮৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করে বহু ত্যাগ তিতিক্ষা পাড়ি দিয়ে সাংবাদিকতার সূচনা করে ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল মৃত্যু বরণ করেন। এছাড়াও জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, কবি আজিজুর রহমান, বাঘা যতীন। নীল কর অন্দলনের প্রথিকৃত জমিদার প্যারী সুন্দরী অভিভক্ত ভারতে প্রদান বিচার পতি ও কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং হিরোসীমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরনের প্রতিবাদী ড. রাধা বিনোদ পাল বিশিষ্ট্য কথা সাহিত্যিক কবি দাদা আলী সহ অশংখ্য কবি সাহিত্যিক বরেণ্য ব্যাক্তি ও মনীষীর স্মৃতিবিজোড়ির সাহিত্য সংস্কৃতির অন্যতম পাদপীঠ কুষ্টিয়া জেলা। বৃটিশ বিরোধি অন্দোলনের ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ তিতিখ্যা ও সেবার কারণে এই জেলার অনেক মাটি ও মানুষের অত্যন্ত গর্বিত। বিপ্লবি বাঘা যতীন, সরোজ আর্চার্য, অতুল কৃষ্ণ, সুনীল সেন গুপ্ত, যতীশ চন্দ্র এবং অন্ত হরি প্রমুখ স্বদেশি বিপ্লবীরা দেশ ও মাতৃকার নিঃস্বার্থ সেবার কারণে স্বরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন গোটা দেশ ব্যাপী। স্বদেশি আন্দোলনের পাশাপাশি ওহাবী আন্দোলনের কাজী মিয়াহজান, খেলাফত আন্দোলনে আশরাফ উদ্দিন আহম্মেদ, কৃষক প্রজা আন্দোলনের শামসুদ্দিন আহমেদ, খেলাফত আন্দোলনে প্রফেসর আব্দুস সাত্তার, পথিকৃত পুরুষ ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ, ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলন, ১৯৬৯ গণঅর্ভুত্থান, ১৯৭১ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ সহ বিভিন্ন ই্যসুতে জাতীয় আন্দেলনে কুষ্টিয়া বাসির ভূমিকা অগ্রহগণ্য। মুক্তযুদ্ধে অবিস্মরনীয় ভূমিকার কারণে বৃহত্তর কুষ্টিয়ায় সামগ্রীক ইতিহাসে স্বতস্ত্র্য বৈশিষ্ট নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। বৃহত্তর কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজীব নগরে মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাজধানী প্রতিষ্ঠায় এই জেলাকে গৌরবের আসনে সমাসীন করেছে। অসংখ্য কবি সাহিত্যিক, শিল্পি, কুশলী ও চিত্রকরের অনন্য অবদানের কারনে সারা দেশের মধ্যে কুষ্টিয়ার সংস্কৃতির রাজধানী হিসাবে খ্যাতী পেয়েছেন। বর্তমান বৃহত্তর কুষ্টিয়া স্বাধীনতা উত্তর ১৯টি জেলার মধ্যে ছিল ১৮তম ৪৭ উত্তর দেশবিভাগের পর মুসলীম সংখ্যা গরিষ্ঠ্য অঞ্চল হিসাবে এটি পূর্ব বাংলার অন্তরভুক্ত হয়। বিভাগপূর্ব সময়ে এটি ছির একটি অবিভক্ত নদীয়া জেলার একটি অংশ। তৎকালীন সময়ে নদীয়া জেলা মহকুমা ছিল ৫টি। এগুলো হল কৃষ্ণনগর, কুস্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, রানাঘাট। পাকিস্তার সৃষ্টিরপর কুষ্টিয়া মেহেরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা নিয়ে স্বাধীন দেশ “কুষ্টিয়া জেলা” গঠিত হয়। প্রথম পর্যায়ে সামগ্রীকভাবে এই জেলার নামকরণ করা হয় নদীয়া। আর ভারত ভূখ-ে পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া অংশকে বালা হয় নবদ্বীপ। পরবর্তীতে প্রমাসনিক কার্যক্রম ও চিঠিপত্র আদান প্রদানে জটিলতা দেখা দেয়। ফলে কুষ্টিয়ার নদীয়াকে কুষ্টিয়া জেলা করা হয়। তাই কুষ্টিয়ার ইতিহাস অনের প্রাচীন। কুষ্টিয়ার প্রথম মহকুমা হয় ১৮৬০ সালে। কুষ্টিয়ার নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনী। কুষ্টিয়ায় এক সময় কোষ্টার (পাট) চাষ হত বলে কোষ্টা শব্দ থেকে কুষ্টিয়া নামকরণ হয়েছে। হেমিলটনের গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে যে স্থানীয় জনগণ এক কুষ্টি বলে ডাকত বলে এর নাম হয়েছে কুষ্টিয়া। অনেকের মতে ফরাসি শব্দ “কুশতহ” যার অর্থ ছাই দ্বীপ থেকে কুষ্টিয়ার নামকরণ হয়েছে। স¤্রাট শাজাহানের সময় কুষ্টি বন্দরকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের উৎপত্তি ঘটেছে। প্রচীন জনপদ হিসাবে কুষ্টিয়া নামকরনের ইতিাহাস সম্পর্কে জানা যায়, কুষ্টি শব্দ থেকে কুষ্টিয়া শব্দটি এসছে। কুষ্টিয়া নামকরনের ব্যাপারে বেশ কিছু যুক্তিও আছে। এই জেলার এক শ্রেণীর ব্যাক্তিবর্গ এখনও কুষ্টিয়াকে কুষ্টে বলে আখ্যায়িত করে। অনেকের মতে কুষ্টা থেকে কুষ্টিয়ার নামের উৎপত্তি। এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে কুষ্টা জন্মায় বলে এই নামের সৃষ্টি হতে পারে। সৈয়দ মুর্তাজা আলীর মতে কুষ্টিয়া শব্দটি ফার্সি কুশতহ বা কুস্তা থেকে এসেছে। অনেকের মতে কুস্তি খেলাকে কেন্দ্র করে বা কুষ্টি এবং সবশেষে কুষ্টিয়া নামে উৎপত্তি হয়েছে। ড. মুক্তি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, কাষ্টিয়া শব্দ থেকে এসছে কুষ্টিয়া। কাষ্টিয়া শব্দটি চুরুনী ভাষা। কাস্টিয়া অর্থ ওলি আওলিয়াদের বসবাসের জায়গা। এই জেলায় ওলি আওলিয়া গাউস, কুতুব, পীর, বুজুরগ বসবাস করার কারণে কাষ্টিয়া থেকে কুষ্টিয়া জেলার নাম করণ করা হয়েছে। স¤্রাট শাজাহানের আমলে এই স্থাটি গড়ে উঠেছিল নৌবন্দর হিসাবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনীর আমলে কুিিষ্টয়ার কুমারখালীর নদীবন্দর হিসাবে খ্যাত ছিল। এই জন্য প্রাচীন সভ্যতার অনেক নিদর্শন কুমারখালীতে দেখা যায়। ১৭২৫ সালে কুষ্টিয়া নাটরের জমিদারদের অধীনে ছিল। এর পরিচিতি আসে কান্ডা নগর পরগনার রাজশাহী ফোজদারীর সিভির প্রশাসনের অর্ন্তভুক্তিতে। পরে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডয়া কোম্পানির ১৭৭৬ সালের কুষ্টিয়াকে যশোর জেলায় অর্ন্তভুক্ত করে। কিন্তু ১৮২৮ সালে পাবনা জেলায় অন্তভৃক্ত হয়। ১৮৬১ সালে নীল বিদ্রোহোর কারণে কুষ্টিয়া মহকুমার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এবং ১৮৭১ সালে কুমারখালী ও খোকসা থানা নিয়ে কুষ্টিয় মহকুমার নদীয়ায় অর্ন্তগত হয়। ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির পূর্বে কুষ্টিয়া নদীয়া জেলার একটি মহকুমা ছিল। ১৯৪৭ সালে কুষ্টিয়া জেলার অভ্যুদয় ঘটে। তখন কুষ্টিয়া জেলা ৩টি মহকুমা নিয়ে গঠিত ছিল। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর। এরপর ১৯৮৪ সালে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর আলাদা জেলা হিসাবে পৃথক হয়ে গেলে কুষ্টিয়া মহকুমায় ৬টি থানা থাকে। সীমানাঃ- কুষ্টিয়া জেলার উত্তর পশ্চিম এবং উত্তরে পদ্মা নদীর অপর তীরে রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা জেলা, দক্ষিণে ঝিনাইদহ জেলা, পশ্চিমে মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলা এব্ং ভারতের নদীয়া ও মুরশিদাবাদ জেলা এবং পূর্বে রাজবাড়ী জেলা অবস্থিত। ভারতের সাথে কুষ্টিয়ার ৪৬.৬৯ কিলোমিটার সিমান্ত এলাকা আছে। কুষ্টিয়াকে বাংলাদেশের মানুষ ১২ আওলিয়ার দেশ বলে জানে। তার মধ্যে বাবা নফরশাহ্ এর মাজার, সুফি সলেমান শাহ্ এর মাজার ভেড়ামারায় অবস্থিত। উল্লেখযোগ্য স্থানঃ- সৈয়দ-মাস-উদ-রুমী সেতু, মীর মোশারফের বাস্তুু ভিটা, কাঙাল কুঠির, টেগোর লজ ও মোহিনি মিলস্ , রেনউইক বাদ, ঝাউদিয়া শাহী মসজিদ, স্বস্তীপুর শাহী মসজিদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠি বাড়ী, ফকির লালন শাহ্ এর মাজার, সোলাইমান শাহ্ এর মাজার, বাবা নফর শাহ্ এর মাজার, কুষ্টিয়া সুগার মিলস্, হাডিং ব্রিজ ভেড়ামারায় অবস্থিত। নতুন প্রজন্মের সৃষ্টির মধ্যে বি. আর. বি. গ্রুপ অফ ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিঃ, নির্মানাধীন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, হরিপুর সংযোগ সেতু, সুইমিং স্টেডিয়াম, বাইপাস সড়ক, লালন শাহ্ সেতু সহ অনান্য খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের বাসস্থান ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এই কুষ্টিয়া জেলাতে অবস্থিত।
Posted in বাংলাদেশ
এক নজরে কুষ্টিয়ার ইতিহাস
January 16, 2019