বিশ্বে পঞ্চম বাংলাদেশ গরিব মানুষের বসবাসে

অনলাইন ডেস্ক: অতিধনী বৃদ্ধির হারের দিকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। ধনী বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। দ্রুত মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি বা ধনী হওয়ার যাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও অতিগরিব মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। অতিগরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশে ২ কোটি ৪১ লাখ হতদরিদ্র মানুষ আছে।
বিশ্বব্যাংক ‘পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি বা দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি হতদরিদ্র মানুষ আছে, এমন ১০টি দেশের তালিকা তৈরি করেছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে (পিপিপি) যাঁদের দৈনিক আয় ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম, তাঁদের হতদরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটা আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্বব্যাংক ২০১৬ সালের মূল্যমান ধরে পিপিপি ডলার হিসাবে করেছে। বাংলাদেশে প্রতি পিপিপি ডলারের মান ধরা হয়েছে সাড়ে ৩২ টাকা। সেই হিসাবে বাংলাদেশের ২ কোটি ৪১ লাখ লোক দৈনিক ৬১ টাকা ৬০ পয়সাও আয় করতে পারেন না।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় ঢুকে গেছে। যদিও বাংলাদেশ এখনো নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। এ কারণে বিশ্বব্যাংক নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অতিগরিব মানুষের একটি আলাদা হিসাবও দিয়েছে। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে হলে দৈনিক কমপক্ষে ৩ দশমিক ২ পিপিপি ডলার আয় করতে হবে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এভাবে হিসাব করলে বাংলাদেশে অতিগরিব মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৮ কোটি ৬২ লাখ। আর দারিদ্র্যের হার হবে ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মানে হলো, টেকসইভাবে গরিবি হটাতে বাংলাদেশের প্রায় ৬ কোটি ২১ লাখ মানুষকে দ্রুত দৈনিক ৩ দশমিক ২ ডলার আয়ের সংস্থান করতে হবে। এই বিশাল জনগোষ্ঠী এখন ঝুঁকিতে আছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে সবচেয়ে বেশি ১৭ কোটি ৫৭ লাখ হতদরিদ্র আছে। ভারত ছাড়া বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হতদরিদ্র মানুষ বসবাস করে নাইজেরিয়া, কঙ্গো ও ইথিওপিয়ায়। তালিকায় থাকা শীর্ষ ১০–এর অন্য ৫টি দেশ হলো তানজানিয়া, মাদাগাস্কার, কেনিয়া, মোজাম্বিক ও ইন্দোনেশিয়া।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আগে দারিদ্র্য কমানোর পূর্বশর্ত ছিল প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দারিদ্র্য কমাতে হবে। দেশে ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও হয়েছে। এত প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর দেখা যাচ্ছে প্রবৃদ্ধি যেমন বেড়েছে, বৈষম্যও বেড়েছে। অন্যদিকে দারিদ্র্য হ্রাসের গতিও কমেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দিয়ে দারিদ্র্য নির্মূল করা যাবে, এটা ঠিক নয়। তাঁর মতে, প্রবৃদ্ধিতে গরিব মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। গরিব মানুষের সম্পদ হলো পরিশ্রম। এই শ্রমের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে গরিব মানুষের মজুরি বাড়াতে হবে। আবার কৃষির বাইরের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের জন্য গরিব মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর নজর দিতে হবে।

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছে। তাই ৩ দশমিক ২ ডলারের দৈনিক আয়ের হিসাবও মাথায় রাখতে হবে। যে বিশাল জনগোষ্ঠী দুই হিসাবের মধ্যবর্তী স্থানে আছে, তাদের দ্রুত আয় বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করতে হবে।

আয়ের বৈষম্য পরিমাপের পদ্ধতি হচ্ছে জিনি (বা গিনি) সহগ। বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর মান এখন ০.৪৮৩। জিনি সহগ ০.৫ পেরিয়ে গেলে তাকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ বলা হয়। বাংলাদেশ এর খুব কাছে পৌঁছে গেছে।

গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স বলেছে, অতিধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ প্রথম। গত বুধবার একই প্রতিষ্ঠান আরেকটি প্রতিবেদনে বলেছে, ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ তৃতীয়। আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশের ধনী মানুষের সংখ্যা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্যের কোঠায় দারিদ্র্য নামিয়ে আনা। এই সময়সীমার দুই-তিন বছর আগেই এই লক্ষ্য অর্জন করতে চায় বাংলাদেশ। অর্থাৎ আগামী ১০ বছরে হতদরিদ্রের হার ৩ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এখন বাংলাদেশে অতিদারিদ্র্য হার ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০৩০ সালে যখন অতিদারিদ্র্য হার ৩ শতাংশে মধ্যে নেমে আসবে, তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটিতে পৌঁছাবে। এর মানে, তখনো বাংলাদেশে প্রায় ৬০ লাখ লোক অতিগরিব থেকে যাবে।

এই বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য নির্মূলকে প্রাধান্য দিয়ে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে শোভন কাজের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে গুণগত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করা হবে। এ ছাড়া এখন যে অঞ্চলভিত্তিক দারিদ্র্য ও আয়বৈষম্য আছে, তাতেও বিশেষ নজর দেওয়া হবে।

নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের হিসেবে দারিদ্র্যসীমার ওপরে ওঠার জন্য আয় বৃদ্ধির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শামসুল আলম বলেন, বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে ২০২১ সালের মধ্যে অর্থনীতির সক্ষমতাও বাড়বে। আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনও আসবে।

কোন দেশে কত গরিব

বিশ্বব্যাংকের তালিকা অনুসারে, শীর্ষ স্থানে থাকা ভারতে অতিগরিব মানুষের সংখ্যা ১৭ কোটি ৫৭ লাখ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা নাইজেরিয়ায় ৮ কোটি ২৬ লাখ, তৃতীয় স্থানে থাকা কঙ্গোতে ৫ কোটি ৩২ লাখ ও চতুর্থ স্থানে থাকা ইথিওপিয়ায় ২ কোটি ৬৭ লাখ অতিগরিবের বসবাস। এ ছাড়া ষষ্ঠ থেকে দশম স্থানে থাকা তানজানিয়ায় ২ কোটি ৭ লাখ, কেনিয়ায় ১ কোটি ৭৪ লাখ, মাদাগাস্কারে ১ কোটি ৭৩ লাখ, মোজাম্বিকে ১ কোটি ৭১ লাখ ও ইন্দোনেশিয়ায় ১ কোটি ৫১ লাখ অতিগরিব মানুষের বসবাস। সব মিলিয়ে সারা বিশ্বে এখন ৭৩ কোটি ৬০ লাখ হতদরিদ্র মানুষ আছে। ওই ১০টি দেশেই বাস করে ৪৫ কোটি অতিদরিদ্র মানুষ। এই সংস্থাটি আরও বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে এমন গরিব মানুষের সংখ্যা কমে দাঁড়াবে ৪৭ কোটি ৯০ লাখে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *