ইরান সোলাইমানি হত্যার কী ধরনের প্রতিশোধ নিতে পারে?

অনলাইন ডেস্ক : মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সামরিক জেনারেল কাসেম সোলাইমানি কুদস বাহিনীর প্রধান হিসেবে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইরানের কৌশলগত অপারেশনের নেতৃত্ব দিতেন। তাকে হত্যা করায় আমেরিকার বিরুদ্ধে ‘বড় ধরনের প্রতিশোধ’ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইরান। তবে কীভাবে বা কোথায় এ প্রতিশোধ নেয়া হবে, ইরান কি পাল্টা সামরিক হামলা চালাবে, নাকি সাইবার আক্রমণ হবে – তা নিয়ে সারা বিশ্বের সামরিক-কৌশল বিশেষজ্ঞরা নানা রকম বিশ্লেষণ দিচ্ছেন।

জেনারেল সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ মারান্দি জানান, এই অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য ধরে রাখার পরিকল্পনা পরাজিত করার জন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, “আমেরিকা সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব নষ্ট করতে চেয়েছিল, ইরাককে দখল করে রাখতে চেয়েছিল, ইজরায়েল লেবাননে দখলদারি করতে চেয়েছিল, সৌদি আরব এবং মার্কিনীরা ইয়েমেনকে পদানত করতে চেয়েছিল। জেনারেল সোলাইমানি এই মার্কিন আধিপত্যের সবগুলো পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছেন। মার্কিনীদের সাম্রাজ্য কায়েমের চেষ্টায় তিনি ছিলেন কাঁটার মতো। এটাই তাকে হত্যা করার কারণ।”
তবে সোলাইমানির শূন্যস্থান পূরণ হবে না, বা তাকে ছাড়া ইরানের আঞ্চলিক নীতি এগিয়ে নিতে সমস্যা হবে – এমনটা মানতে নারাজ সৈয়দ মোহাম্মদ মারান্দি।

বর্তমানে জেনারেল কাসেম সোলাইমানির জায়গায় এসেছেন জেনারেল এসমায়েল কানি। যিনি নিজেও একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। সোলাইমানির যোগ্য সহযোগীদের নিয়ে তিনি নতুন চিন্তা ও নতুন নির্দেশনা নিয়ে সফলভাবে কাজ করবেন বলে মনে করেন তিনি।।

অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ মারান্দি বলেন, “জেনারেল সোলাইমানি একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের লোক ছিলেন। তার স্থলে যিনি এসেছেন তিনিও অভিজ্ঞ। তাছাড়া ইরান কোন একক ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল নয়। তাই জেনারেল সোলাইমানির স্থান পূরণ হবে না; বিষয়টি এমন নয়।”

তার মানে কি এই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা ভেবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা পূরণ হবে না? এমন প্রশ্নের জবাবে মারান্দি বলেন, “আমি মনে করি আমেরিকা বোকার মতো কাজ করেছে। এটা ছিল যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। এতে ইরান আরও ক্রুদ্ধ হয়েছে, ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবিলা করতে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে।”

তার মতে, সোলাইমানিকে হত্যা করে আমেরিকা আসলে ইরানকে আরও শক্তিশালী করে দিয়েছে। এতে একজন ইরাকি কমান্ডারও নিহত হওয়ায়, ইরাক ও ইরান উভয় দেশের বিরুদ্ধেই যুক্তরাষ্ট্র এক প্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

অবশ্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন তিনি যুদ্ধ ঠেকাতেই এ আক্রমণ চালিয়েছেন। এ প্রসঙ্গ তুললে ড. মারান্দি বলেন, “তিনি (ট্রাম্প) তো নিজেই যুদ্ধে নেমে পড়লেন। আমার মনে হয় না, ইরানের কেউই ট্রাম্পকে গুরুত্বের সাথে নেয়। বরং এই হামলা, আমেরিকার বিরুদ্ধে দুই দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে – যা তাদেরই ক্ষতি করবে।”

ইরান এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার কথা বলে আসছে, সেই প্রতিশোধ কি ধরনের হতে পারে, সেটা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

ইরানিরা পরিশীলিত জাতি, আমেরিকানদের মতো অমার্জিত ও পাশবিক নয় উল্লেখ করে ড. সৈয়দ মোহাম্মদ মারান্দি বলেন, “ইরানিরা রাজনীতি করে দাবা খেলোয়াড়ের মতো। তারা হিসাব করে, অনেক চিন্তা ভাবনা করে এমন কিছু করবে যাতে আমেরিকানরা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করে।”

ইরানের এই প্রতিশোধ নিয়ে নানা গুঞ্জন উঠেছে। এ আক্রমণ কি সামরিক হবে না সাইবার আক্রমণ হবে, মধ্যপ্রাচ্যে হবে না উত্তর আফ্রিকায় হবে, নানা জল্পনা চলছে। তবে আসলে কি ঘটবে, এমন কোন ধারণা দিতে পারেননি মারান্দি। তবে তিনি বলেছেন, ইরানি এবং ইরাকিদেরও নানা ধরনের সক্ষমতা আছে। আমেরিকানদের অনেক দুর্বল জায়গা আছে।

তার মতে, ইরানিরা অনেক ভাবনাচিন্তা করে উপযুক্ত জবাব কি হবে তা ঠিক করবে – যাতে আমেরিকানদের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে হয়। তবে কী হবে সেটা এখনই বলা যাবে না।

ইরান কোন আক্রমণ চালালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার পাল্টা হামলা চালাতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা জবাব সামলে নেয়ার ব্যাপারে ইরান কতোটা প্রস্তুত?

এ বিষয়ে মারান্দি জানান, ইরান যে আমেরিকাকে শাস্তি দেবে এ নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। ইরানিরা যুদ্ধ চায় না। তবে যুদ্ধ বাধলে তারা পালিয়ে যাবে না। আমেরিকা যা করেছে তা যুদ্ধের শামিল – তাই আমেরিকাকে, ইরান শাস্তি দেবে। আমেরিকান, সৌদি এবং আমিরাতদের যা আছে ইরান তা সব ধ্বংস করে দেবে। তখন আমেরিকানরা বুঝবে যে তারা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে”, যোগ করেন তিনি।

এক্ষেত্রে ইরানের শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেনসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল জুড়ে থাকা মিত্র দেশগুলো। এছাড়া মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ইরানের অনেক রকম সক্ষমতা আছে বলেও মনে করেন মারান্দি।

“ইরান কঠোর না হলে আমেরিকানরা আবার এমন কাজ করবে। আমেরিকা জানে ইরানে তারা যদি আবার আক্রমণ চালায় তাহলে ইরানের জবাব হবে আরও তীব্র। আমেরিকানরা জানে যে এ যুদ্ধে তারা জিততে পারবে না।”

জেনারেল সোলেইমানির মৃত্যু মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্র দেশগুলোয় প্রভাব ফেলবে বলে জানান মারান্দি। তিনি বলেন, “ইরান থেকে লেবানন পর্যন্ত যে শিয়া ক্রিসেন্ট রয়েছে তার পাশাপাশি সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানের সুন্নি সম্প্রদায়ও ইরানের মিত্রদেশ। জেনারেল সোলাইমানির মৃত্যুতে তারা এক হয়ে আরও শক্তিশালী হবে। আমেরিকা খুবই বোকার মতো একটা কাজ করেছে।”

ইরান সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে থাকায় তাদের সামরিক সংঘাতে যাবার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ ব্যাপারেমারান্দি অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রকেই অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় দেখছেন। তার মতে দুই দেশের মধ্যে কোন সংঘাত হলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি বেশি হবে।সূত্র :বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *