অনলাইন ডেস্ক : দেশে ব্যাংকান্স্যুরেন্স ব্যবস্থা প্রবর্তন হতে যাচ্ছে। এ ব্যবস্থায় বীমা কম্পানির পণ্য ও সেবা (বীমা পলিসি) বিক্রি করবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এ কার্যক্রম পরিচালনার একটি খসড়া নীতিমালা করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে অনেক ব্যাংক। এরই মধ্যেই বেসরকারি ও বিদেশি খাতের ৯টি ব্যাংক বীমা পণ্য বিপণন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনাপত্তি চেয়ে আবেদনও করেছে। তবে ব্যাংকগুলো এ ধরনের সেবা দিতে পারে কি না তার আইনগত দিক পর্যালোচনা এবং ঝুঁকির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য দুজন আইনজীবীর মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আইনি দিক পর্যালোচনা, অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং খাতে এর প্রভাব ও ঝুঁকি বিশ্লেষণের জন্য শিগগিরই আগ্রহী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা হবে বলে জানা গেছে।
ব্যাংকান্স্যুরেন্স একটি ফরাসি শব্দ, যার অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে বীমা পণ্য বিক্রি। ১৯৮০ সালের দিকে ফ্রান্স ও স্পেনে প্রথম ব্যাংকান্স্যুরেন্স ধারণার উদ্ভব হয়। জানা যায়, বিগত দশকগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংক ও বীমা কম্পানিগুলো ব্যাংকান্স্যুরেন্সের মাধ্যমে তাঁদের পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল হয়েছে। এশিয়া, সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ যেমন : মালয়েশিয়া, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনে এ ব্যবসায় বেশ প্রসার পেয়েছে। বর্তমানে এশিয়ার দেশগুলোতেও জনপ্রিয় হচ্ছে ব্যাংকান্স্যুরেন্স। বিশেষ করে লাইফ বীমা পলিসি বিক্রিতে এটি শীর্ষ মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
ব্যাংক ও বীমা খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংকান্স্যুরেন্স পদ্ধতিতে একটি কার্যকর বিকল্প চ্যানেল হিসেবে কাজ করে ব্যাংক। এতে বীমা কম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম সংগ্রহে খরচ কম হয়। অন্যদিকে অতিরিক্ত কোনো খরচ ছাড়াই ব্যাংক তার গ্রাহকদের বীমার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে। তা ছাড়া ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বেশি থাকায় গ্রাহকদেরও বীমা পলিসি কেনার প্রতি বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর গভর্নরের সভাপতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় আইডিআরএ ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে মতামত পাওয়ার পর ব্যাংকের প্রস্তাবিত ব্যাংকান্স্যুরেন্স ব্যবস্থায় বীমা পণ্য বিক্রির অনুমোদনের বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। আইডিআরএ এরই মধ্যেই এ বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। নীতিমালায় বীমা কম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং এ ব্যবসা পরিচালনায় আইডিআরএর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কী হবে সে বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। এদিকে আইডিআরএর অনুমোদিত বীমা কম্পানির বীমা পণ্য বিপণন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনাপত্তি চেয়ে আবেদন করেছে প্রায় ৯টি ব্যাংক। এগুলো হলো বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো চিঠিতে ব্যাংকগুলো উল্লেখ করেছে, ব্যাংকান্স্যুরেন্স ব্যবস্থায় ব্যাংক ও বীমা কম্পানির মধ্যে সম্পাদিত অংশীদারি চুক্তির আওতায় ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের মধ্যে বীমা কম্পানির পক্ষে বীমাপণ্য বিক্রয় করবে। এতে ব্যাংকের কমিশন আয় বৃদ্ধি পাবে এবং বীমা কম্পানির ব্যবসা প্রসারের মাধ্যমে উভয় প্রতিষ্ঠান লাভবান হবে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো বীমাপণ্য বিপণন কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পেলে তাঁদের গ্রাহকদের ওয়ান স্টপ আর্থিক সেবা প্রদানে সক্ষম হবে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম বেগবান হওয়ার পাশাপাশি দেশের জিডিপিতে ব্যাংক ও বীমা খাতের অবদান বৃদ্ধি পাবে। জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে গার্ডিয়ান লাইফ ইনস্যুরেন্সকে তাদের পণ্য ব্যাংকের মাধ্যমে বিপণনে আইডিআরএ অনুমোদন দিয়েছে। আগ্রহী ব্যাংকগুলো এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ব্যবসা পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ব্যাংক কম্পানি আইনের ৭(১)(ঢ) ধারায় বলা হয়েছে, ব্যাংক প্রয়োজনে কারো এজেন্সি বা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইনস্যুরেন্স ব্যবসায়ে ব্যাংকের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে আইনে সুনির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে সংশোধিত ব্যাংক কম্পানি আইনের ৭(৩) ধারায় নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক কম্পানি স্টক-ব্রোকার, স্টক-ডিলার, মার্চেন্ট ব্যাংকার, পোর্টফলিও ম্যানেজার হিসেবে বা সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকে নিবন্ধন গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে—এ ধরনের ব্যবসায় সরাসরি লিপ্ত হতে পারবে না।
তাই ব্যাংকান্স্যুরেন্স ব্যবসা পরিচালনায় আইনি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে কি না এবং বীমাপণ্য বিক্রির মতো অ-ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে ব্যাংকগুলোকে কতটা সম্পৃক্ত করা সমীচীন হবে তা পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো বীমা কম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করলে বীমা খাতের ঝুঁকি কী মাত্রায় ব্যাংকিং খাতকে প্রভাবিত করবে সে বিষয়টিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।