কুষ্টিয়া জেলার ২৫০টি পূজা মণ্ডপে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু

সজীব নন্দী (কুষ্টিয়া ) :

 

কুষ্টিয়া জেলায় ২৫০ টি পূজা মণ্ডপে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে।সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার মহাসপ্তমী আজ।কুষ্টিয়া শহরের আড়ুয়াপাড়া হরিবাসর সার্বজনীন পূজা মন্দির কমিটির আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব । অশুভ শক্তিকে শোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে হিন্দুসম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা।

 

গতকাল রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ছিল মহাষষ্ঠী। এদিন দেবী দুর্গা শক্তি নিয়ে ভক্তদের কাছে পৌঁছান। গতকাল রবিবার ৮টায় বোধনের পর খুলে দেওয়া হয় মণ্ডপ। এর মাধ্যমে দেবী জেগে ওঠেন। আর তাতে দর্শন করা যায় দেবীর। রবিবার সকাল থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে চলেছে দেবীকে জাগানোর জন্য পূজা অর্পণ। পুরোহিতরা জানান, এর মধ্যে দিয়েই দুর্গাপূজা শুরু হয়।

 

আজ সোমবার ( ২৯ সেপ্টেম্বর)মহাসপ্তমী। শাস্ত্রমতে মহাসপ্তমীতে ষোড়শ উপাচারে (ষোল উপাদানে) দেবীর পূজা হবে। সকালে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হবে। একই সঙ্গে দেবীকে আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, পুষ্পমাল্য, চন্দন, ধূপ ও দীপ দিয়ে পূজা করবেন ভক্তরা। এ সময় পূজারীরা প্রতিমার সামনে বসে মায়ের মুখ দর্শন করবেন।

কুষ্টিয়া জেলার মন্দিরসহ সব মন্দিরেই সকাল থেকে শুরু হবে সপ্তমী পূজার আনুষ্ঠানিকতা। মহাসপ্তমীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে সকাল  ১২টা ৫৬ মিনিট ৪৮ সেকেন্ট পর্যন্ত মহাসপ্তমী। এছাড়াও দিনব্যাপী চণ্ডী ও মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে পূজা, দেবী-দর্শন, দেবীর পায়ে ভক্তদের অঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ গ্রহণের মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা চলবে বলে জানান সর্বজনীন পূজা আয়োজকরা ।

যদিও দুর্গাপূজা শুরু হলো সোমবার থেকে, তবে দেবী আসার ঘণ্টা বেজে যায় মহালয়ার দিন থেকেই। সনাতন ধর্ম মতে, যা কিছু দুঃখ-কষ্টের বিষয়, যেমন–বাধাবিঘ্ন, ভয়, দুঃখ-শোক, জ্বালা-যন্ত্রণা এসব থেকে ভক্তকে রক্ষা করেন দেবী দুর্গা। শাস্ত্রকাররা দুর্গা নামের অর্থ করেছেন—দুঃখের দ্বারা যাকে লাভ করা যায়, তিনিই দুর্গা। দেবী দুঃখ দিয়ে মানুষের সহ্যক্ষমতা পরীক্ষা করেন। তখন মানুষ অস্থির না হয়ে তাকে ডাকলেই তিনি তার কষ্ট দূর করেন। এ বছর দেবী দুর্গা আগমন ঘটছে গজে চড়ে । গজে দেবীর আগমনকে অশুভ বলে মনে করা হয়। বলা হয়, এতে পৃথিবীর ওপর খুব নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে এ বছর দেবী দুর্গা কৈলাশে ফিরবেন দোলা চড়ে, যেটিও অশুভ ইঙ্গিত বহন করে। সে হিসাবে এ বছর মহামারি বা মড়ক, ভূমিকম্প, খরা, যুদ্ধ, অতিমৃত্যুর মতো দুর্যোগের শঙ্কা রয়েছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর মহাষ্টমী, ১ অক্টোবর মহানবমী, ২ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শারদীয় দুর্গাপূজার পরিসমাপ্তি ঘটবে।

 

মহাঅষ্টমীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে  মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর, ১৪ আশ্বিন)  সকাল ৬টা ১০ মিনিটে এবং বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত হবে কুমারী পূজা। সন্ধিপূজা শুরু হবে রাত ৮টা ৬ মিনিটে। বুধবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে শুরু হবে নবমী পূজা। পরদিন বৃহস্পতিবার দশমী পূজা শুরু সকাল ৬টা ৩০ মিনিট। পূজা সমাপন ও দর্পণ বিসর্জন হবে সকাল ৯টা ৪৯ মিনিটের মধ্যে। সন্ধ্যায় আরাত্রিকের পর প্রতিমা বিসর্জন ও শান্তিজল গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনব্যাপী এ উৎসবের।

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভাতৃত্ববোধ বজায় রেখে সরকারি সকল নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গোৎসব উদযাপন করতে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করা হয়েছে।

 

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের দেওয়া তথ্য মতে, এবার সারাদেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপ ও মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। গত বছর সারাদেশে ৩১ হাজার ৪৬১টি দুর্গাপূজা হয়েছিল। সেই হিসেবে এবার ১ হাজার ৮৯৪টি দুর্গাপূজা বেশি হচ্ছে। কুষ্টিয়া জেলার পূজার সংখ্যা ২৫০,গত বছর ছিল ২৩০ । 

 

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী,এ বছর কুষ্টিয়ার ছয় উপজেলায় ২৫০ মণ্ডপে শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৮১টি, খোকসা উপজেলায় ৫৯টি, কুমারখালী উপজেলায় ৫৯টি, মিরপুর উপজেলায় ২৮টি, ভেড়ামারায় ১১টি ও দৌলতপুরে ১২টি মণ্ডপে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। গত বছরের তুলনায় এবার ২২টি মণ্ডপে পূজা বেড়েছে।

 

কুষ্টিয়া হরিবাসর মন্দিরের পূরোহিত রতন চক্রবর্তী বলেন, গতকাল রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর)ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু  হয়েছে শারদীয় দূর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা। মা দুর্গা সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। আমরা পূজার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। সোমবার ( ২৯ সেপ্টেম্বর) বোধন পূজার মাধ্যমে শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হবে। ২৮ সেপ্টেম্বর মহাষষ্ঠী, ২৯ সেপ্টেম্বর মহাসপ্তমী, ৩০ সেপ্টেম্বর মহাষ্টমী, ১ অক্টোবর মহানবমী, ২ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শারদীয় দুর্গাপূজার পরিসমাপ্তি ঘটবে।

 

কুষ্টিয়া মহাশ্মশান মন্দিরের পুরোহিত পলাশ চক্রবর্ত্তী বলেন, আগামী ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবী পক্ষের সূচনা হবে। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর মহাষষ্ঠী এবং ২ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের সমাপ্তি ঘটবে। এবার পৃথিবীতে দশভুজার আগমণ হবে হাতিতে চড়ে আর কৈলাশে ফিরবেন দোলায়।

 

কুষ্টিয়া জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. জয়দেব বিশ্বাস বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর ২২টি পূজা বেশি হচ্ছে। এবার জেলায় ২৫০টি পূজা মন্দিরে সরকারের সকল নির্দেশনা মোতাবেক পূজা অনুষ্ঠিত হবে। প্রশাসনের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক রাখার ব্যবস্থা হয়েছে।

 

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভাতৃত্ববোধ বজায় রেখে সরকারি সকল নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গোৎসব উদযাপন করতে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করা হয়েছে।মণ্ডপে আনসার বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ মোতায়েন থাকবে। সেইসঙ্গে টহল টিমও কাজ করবে। যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ সতর্ক রয়েছে।

 

এছাড়া পূজা মন্দিরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কুষ্টিয়া জেলা শাখার সদস্যদের পূজামন্দিরে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, স্বেচ্ছাসেবক ও গার্ড নিয়োগ এবং পূজা মন্দিরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পূজা মন্দিরে পালাক্রমে ডিউটির ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। কোথাও কোনো সমস্যা হলে দ্রুত সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের বিট অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পুলিশ সুপারকে অবহিত করার জন্য সকলকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি পূজা মন্দিরে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। পূজা মন্দিরে সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি ছাড়া আনসার মোতায়েন করা হয়েছে।

 

কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন জানান, যার যার ধর্মীয় উৎসব স্বাধীনভাবে ও উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করা তাদের অধিকার। কোনো প্রোপাগান্ডা ও গুজবে কান দেওয়া যাবে না। বর্তমান সরকার মবের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। মব সৃষ্টি করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে

 

সনাতনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মা দুর্গা স্বর্গে কৈলাশ পর্বত হতে গজে চড়ে মহাষষ্ঠী রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর), ১২আশ্বিন)। মহাসপ্তমী পড়েছে  ( ২৯ সেপ্টেম্বর) , ১৩ আশ্বিন)। মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর, ১৪ আশ্বিন) পড়েছে মহাঅষ্টমী। মহানবমী পড়েছে বুধবার (১ অক্টোবর, ১৫ আশ্বিন)। আর পঞ্জিকামতে বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর, ১৬ আশ্বিন) বিজয়ী মহা দশমী ও বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসব সমাপ্ত হবে এবং মা দুর্গা তার ভক্তদের কাঁদিয়ে দোলা বা পালকিতে চড়ে স্বর্গে কৈলাশ পর্বতে গমন করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *