মহাজাগিতক বিদায়বেলার গল্প

অনলাইন ডেস্ক: জগতকে আলোকিত হতে অনিবার্য ছিল এক বিচ্ছেদ। বস্তুকে শেষ আলিঙ্গন করে স্বাধীনতাকামী আলো দিল ছুট, এলোমলো দিগ্বিদিক। কবে ঘটেছিল সেই মহাবিচ্ছেদ? ‘দ্য মিউজিক অব দ্য বিগ ব্যাং’ গ্রন্থের নির্বাচিত অংশের এই অনুবাদে উঠে এসেছে সেই বিয়োগগাথা।
আদিতে বস্তু ও বিকিরণের অভিন্নতা ছিল, আর ছিল তাপীয় ভারসাম্য। সে কারণে কৃষ্ণবস্তুর তাপমাত্রাই ছিল আসলে পুরো মহাবিশ্বের তাপমাত্রা। মহাবিশ্বের প্রসারেণর সাথে সাথে এই তাপমাত্রা কমতে থাকে। তাপমাত্রা কমার সাথে খুব সাধারণ একটা গাণিতিক সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যদি তাপমাত্রাকে কেলভিন এককে মাপি, দেখব, মহাবিশ্বের আয়তন যখন দ্বিগুণ হচ্ছে, তাপমাত্রা কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। কেলভিনকে ইংরেজি বড় ‘কে’ অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয়। সেলসিয়াস এককে এক কেলভিন সমান- ২৭৩ দশমিক ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটা সম্ভাব্য সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, যাকে পরমশূন্য তাপমাত্রা (অ্যাবসোলিউট জিরো) বলা হয়। আদি মহাবিশ্বটা ছিল ‘আগুনেরই মহাগোলা’ যা পরে শীতল থেকে শীতলতর হয়েছে।

আদি ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল এক সাগর আলো। কিন্তু আলো ততটা দূরে পালাতে পারেনি, যতটা আমরা প্রত্যাশা করতে পারি। তড়িৎ আধানযুক্ত কণাদের সঙ্গে তখন জোরালোভাবে মিথষ্ক্রিয়া করত তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ। আদিবিশ্বটা আয়োনিত নিউক্লিয়াস আর মুক্ত ইলেকট্রনের প্লাজমায় ভরপুর ছিল। ফলে এক ইলেকট্রন থেকে আরেক ইলেকট্রনে আলো বিক্ষিপ্ত হতো, বিরামহীন। আলোর এমন এলোমেলো ছুটোছুটি, ঠিক যেন বাম্পার কারের মতো। এরকম একটা পরিস্থিতিতে আলো তো আর বেশি দূর পালিয়ে যেতে পারে না। বস্তুতে ঠাসা অমন ঘনজগতেই আটকা পড়ে থাকত ওরা। এ অবস্থাকে পরিব্যাপন (ডিফিউশন) বলা হয়। এর সাথে একটা কুয়াশাচ্ছন্ন দিনের অনেকখানি মিল রয়েছে। বাতাসে আপতিত কিরণকে এলোমেলোভাবে ইতস্তত ছড়িয়ে দেয় জলীয়বাষ্পরা, যেজন্য দেখা যায় না কিছুই, শুধু ঝাপসা আলো বলে মনে হয়। ঠিক সেরকমই আদি মহাবিশ্বটা ছিল অনচ্ছ, ছায়াচ্ছন্ন।

কিন্তু মহাজাগতিক বিবর্তনের এক পর্যায়ে বস্তুজগতের অবস্থার রূপান্তর হয়েছিল। ভিন্ন আধানের হওয়ায় পারমাণবিক নিউক্লিয়াস আর ইলেকট্রনেরা একে অপরকে আকর্ষণ করত, তৈরি হতো আধান নিরপেক্ষ পরমাণু। অবশ্য বিকিরণ পর্যাপ্ত শক্তিসম্পন্ন হওয়ার আগপর্যন্ত কোনো স্থির পরমাণু গঠিত হয়নি। কেননা, তখনও উচ্চশক্তির অনেক ফোটন ছিল। এদের কারণে নব নব জন্ম নেওয়া পরমাণুরা ভেঙে যেত, দ্রুতই। মহাবিস্ফোরণের তিন লাখ ৮০ হাজার বছর পর সেই মুহূর্ত এসেছিল যখন প্রথম স্থায়ী হাইড্রোজেন পরমাণুর দেখা মিলেছিল। আর ওই সময়ের মধ্যে বেশিরভাগ ফোটনেরই হাইড্রোজেন আয়নায়নের সীমানা ছাড়িয়ে লোহিত সরণ (রেডশিফট) ঘটেছিল। মহাবিশ্বের ইতিহাসে এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে মহাবিশ্বতাত্ত্বিকরা পুনর্সমন্বয় (রিকমবিনেশন) বলে থাকেন।

ঠিক একই সময়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। বস্তু আর বিকিরণের বিচ্ছেদ (ডিকাপলিং)। যেহেতু ফোটনেরা নতুন জন্ম নেওয়া আধান স্থায়ী পরমাণুর সঙ্গে সহজে আর মিথষ্ক্রিয়ায় লিপ্ত হলো না, ওরা এবার মহাজগতে ছড়িয়ে পড়া শুরু করল নির্বিঘ্নে। আর যখন পরমাণু আর ফোটনেরা পরস্পরকে শেষ বিদায় জানাল, তখন মহাবিশ্বটা হয়ে উঠল স্বচ্ছ, দৃশ্যমান।
আর এরই মধ্য দিয়ে বিস্ময়কর এক পরিণতির দিকে ধাবিত হতে থাকল ব্রহ্মাণ্ডটা, আগে যা দেখা যায়নি কখনো। আদি মহাবিশ্বজুড়ে থাকা ফোটনেরা সেই সুদূর অতীতে যখন ছাড়া পেল, তখন থেকে তারা ছুটতে থাকল মহাজাগতের সব দিকে। যদিও বলা বাহুল্য যে, ওরা আর বস্তুর সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে না মোটেও। ওরা আছে আমাদের আশেপাশে, সবখানেই। ওরা আদি অগ্নিশিখার ঈষদুষ্ণ উত্তাপ কিংবা বহুআগের সেই বিস্ফোরণের শান্ত প্রতিধ্বনি। আমরা যদি খুব সংবেদনশীল অ্যান্টেনাকে সঠিক কম্পাঙ্কে তাক করতে পারি, তাহলে মহাবিস্ফোরণের এই স্মৃতিরাগ আমরা ধরতে পারব। সঠিক কম্পাঙ্ক বের করা সহজই।যখন বস্তু থেকে বিকিরণ বিচ্ছেদ হয়েছিল, ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ০.০০১ মিলিমিটার (১ মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের একভাগ মাত্র, এমনকি তখনও ওরা বর্ণলির দৃশ্যমান পাল্লায় ছিল না)। এরই মধ্যে, মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব বলছে, মহাবিশ্বটা হাজার গুণ প্রসারিত হয়ে গেছে। তার মানে, ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে প্রায় এক মিলিমিটার হয়ে গেছে। বর্ণালির মাইক্রোওয়েভ পট্টিতে তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যও একই। এই দুর্বল মাইক্রোওয়েভ বিকিরণকে মহাবিশ্বতাত্ত্বিকরা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (সিএমবি) বলে থাকেন। মহাবিশ্বের জন্মলগ্নের জীবাশ্ম সংকেত হলো এই সিএমবি। যখন পুনর্সমন্বয় ঘটেছিল, প্লাজমার তাপমাত্রা ছিল তিন হাজার কেলভিন। এরপর যেহেতু শীতল হতে থাকে ব্রহ্মাণ্ডটা, ফলে এখন সিএমবিকে বলা চলে অতিশীতল কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ। সিএমবির তাপমাত্রা এখন তিন কেলভিন। বর্তমান মহাবিশ্বের শূন্যস্থানের গড় তাপমাত্রাও একই হওয়া উচিত, পরমশূন্য নয়, বরঞ্চ তার চেয়ে তিন ডিগ্রি বেশি, যেন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আদি আগুনের কুসুম আঁচ।
আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, মহাবিস্ফোরণের কয়েক লাখ বছর পর যখন শেষবারের মতো ইলেকট্রন দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়েছিল, আমাদের অ্যান্টেনায় ধরা পড়া সেই মুহূর্তের পর সিএমবি ফোটনেরা কিন্তু কোনো বস্তুর সঙ্গে আর মিথষ্ক্রিয়া করেনি। সেই সব আদি ও প্রিয় প্রোটনেরা আমাদের পরীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়ার আগে মহাজগতের মাঝারে সোজা পথে ছুটে এসেছে অকল্পনীয় সুদীর্ঘ সময় ধরে। এই সময়টা মহাবিশ্বের বয়সের ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ হয়ে যাবে। মনে করা হয়, মহাবিশ্বের বয়স প্রায় এক হাজার ৩৭০ কোটি বছর। ওইসব ফোটন যখন তাদের দীর্ঘ অভিযাত্রা শুরু করেছিল, তখনকার মহাবিশ্বটা আজকের তুলনায় ছিল অত্যন্ত শিশুবয়সী। অনেকটা আশি বছরের এক মানুষের তুলনায় কয়েক ঘণ্টা আগে জন্ম নেওয়া শিশু যেমন। ফলে ওই সময় শিশু মহাবিশ্বটা ঠিক কেমন ছিল, তার একটা নিখুঁত চিত্র নির্মাণ করার সুবর্ণ সম্ভাবনা কিন্তু আমাদের হাতে রয়েছে।
কেউ ভেবে আশ্চর্য হতে পারে যে, ঠিক কোথা থেকে আসল এসব সিএমবি ফোটনেরা। আমরা বিষয়টাকে এভাবে ভাবতে পারি, পুরো মহাবিশ্বে বস্তু আর বিকিরণের বিচ্ছেদ ঘটেছিল প্রায় একই সময়ে। আর ওই সময়ই সিএমবি ফোটনেরা কমবেশি মুক্তভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। ইলেকট্রনের দ্বারা শেষবারের মতো বিক্ষিপ্ত হওয়ার পর প্রত্যেকটা ফোটন মহাশূন্যের ভিন্ন ভিন্ন বিন্দু থেকে অবমুক্ত হয়েছিল। আর ওরা ছুটতে শুরু করেছিল এলোমেলো, দিগ্বিদিক। আজ আমরা সেসব ফোটনকেই ধরতে পারছি, যারা আমাদের অভিমুখে যাত্রা করেছিল। প্রতিটা ফোটনেরই গতিবেগ একই- আলোর গতির সমান। সুতরাং তারা সবাই একই সমান দূরত্ব পাড়ি দিয়েছে। ফলে আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হবে যে, সবগুলো সিএমবি ফোটন এসেছে বিশাল একটা বলয় থেকে যেটা আমাদের ঘিরে রেখেছে। সর্বশেষ বিক্ষেপণের পর ফোটনেরা ঠিক যতটুকু পথ পাড়ি দিয়েছে, সেই দূরত্বই হবে এই মহাবলয়ের ব্যাসার্ধ।
তবে আরেকজন কাল্পনিক পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অবশ্যই ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে। মহাবিশ্বের অন্য একটা জায়গায় থাকা একজন পর্যবেক্ষক হয়ত দেখবেন, ফোটনেরা ভিন্ন কোনো এক গোলক থেকে ছুটে এসেছে।সিএমবি বিকিরণই হচ্ছে মহাবিশ্বের সবচেয়ে আদি সংকেত। এবং সবচেয়ে দূরের সংকেত যা আমরা শনাক্ত করতে পারি। বস্তুর সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় ফোটনেরা যে জায়গায় সর্বশেষ বিক্ষিপ্ত হয়েছিল, ওই তল পেরিয়ে কিছু দেখতে পাওয়া অসম্ভব। এমন চেষ্টার মানে অনেকটা কোনো নক্ষত্রের ভেতরে কী ঘটছে তা দেখার চেষ্টা করা কিংবা ঘন কোনো মেঘমালার মধ্য দিয়ে কিছু দেখার চেখা করা। বস্তু-বিকিরণ বিচ্ছেদের আগে মহাবিশ্বটা খবুই অনচ্ছ ছিল। যা হোক, সিএমবি দেখতে পাওয়া মানেই মহাবিস্ফোরণের সেই আদি আগুনের গোলাকে সরাসরি চাক্ষস করা। মহাবিশ্বতাত্ত্বিকদের জন্য এই সুযোগটা প্রকৃতির পক্ষ থেকে এক রোমাঞ্চকর উপহার বটে। কিন্তু আমাদের এটা উপলব্ধি করতে কেটে গেছে বহুকাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *