করোনার অধিক ঝুঁকিতে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা

অনলাইন ডেস্ক : দেশব্যাপী লকডাউন এবং জনসাধারণের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা বাস্তবায়নে মূল নেতৃত্বে আছেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। ত্রাণ বিতরণ, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, দরিদ্রদের তালিকা তৈরি, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের দাফন-কাফনসহ সব ধরনের কাজে যুক্ত থাকতে হচ্ছে তাঁদের। এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। এর মধ্যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাই বেশি। আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেকই আবার নারী ম্যাজিস্ট্রেট।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, প্রশাসন ক্যাডারের মাঠ পর্যায়ে মোট ২১ কর্মকর্তা এরই মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৯ জনই নারী। তবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দিষ্টভাবে আক্রান্তদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য কেউ জানাতে পারেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন হবিগঞ্জ জেলার কর্মকর্তারা। এখানে ডিসি কামরুল হাসান ও অতিরিক্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে ইসরাতসহ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ছয় কর্মকর্তা। বাকি চারজনের মধ্যে রয়েছেন বানিয়াচং উপজেলার এসি ল্যান্ড মতিউর রহমান, জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফিয়া আমিন পাপ্পা ও সাঈদ মোহাম্মাদ ইব্রাহিম। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের ইউএনও বৈশাখী বড়ুয়া করোনা আক্রান্ত হয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন জামালপুরের এসি ল্যান্ড মাহমুদা বেগম।

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে গত ৬ এপ্রিল ঢাকায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন দুদকের পরিচালক জালাল সাইফুর। এ ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব আক্রান্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গতকাল মঙ্গলবার বলেন, মাঠ প্রশাসনের ডিসি, ইউএনও এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ফ্রন্টলাইনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত প্রশাসন ক্যাডারের মোট ২৫ জন কর্মকর্তা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই মাঠ প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

নারায়ণগঞ্জ জেলায় সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া তাবাসসুম, ফারজানা আক্তার, আবদুল মতিন খানসহ চার কর্মকর্তা আক্রান্ত হয়েছেন। ডিসি জসিম উদ্দিনও কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। গাজীপুরের টঙ্গী রাজস্ব সার্কেলের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম মোর্শেদ খান পাভেল, কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিমাদ্রী খীসা, সৌদি আরবে লেবার কাউন্সিলর হিসেবে কর্মরত আমিনুল ইসলামও আক্রান্ত হয়েছেন। ভৈরব উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিমাদ্রী খীসা কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। অবশ্য তাঁর নমুনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এসেছে।

নরসিংদী জেলা প্রশাসনের চার কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শেখ ইউসুফ হারুন। তাঁদের সবাই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট—সাখাওয়াত জামিল সৈকত, মেহেদী হাসান কাউছার, ফয়জুর রহমান ও এ বি এম সারোয়ার রাব্বি। তিনি বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের মোট ২১ কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত। নরসিংদীর ডিসি সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন জানান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সব ধরনের কাজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে। এ কারণে তাঁরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের ইউএনও জাকির হোসেন বলেন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিনে রাখা, বাজার মনিটরিং, একাধিক ত্রাণ তালিকা প্রস্তুতের কাজ করতে হয়। এ কারণে মাঠ প্রশাসনে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঢাকা এখন করোনার হট স্পট। ঢাকা মহানগরীতে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দেশের মোট রোগীর ৫৭ শতাংশের বেশি। মহানগরসহ ঢাকা বিভাগে ৮৩ শতাংশের বেশি। ঢাকায় ৭৩টি বস্তিতে এক লাখ ১৩ হাজার পরিবারের বসবাস। ঢাকা বিভাগের নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, আশুলিয়া, গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলগুলোতে জনঘনত্ব বেশি। বস্তি ও শিল্পাঞ্চলগুলোতে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাকে আইসোলেশনে রাখার মতো স্থান পাওয়া যাবে না। এসব কারণে ঢাকা বিভাগে করোনা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।

মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে সংকটে পড়া মানুষদের জন্য ডাটা বেইস তৈরি হচ্ছে। এর মাধ্যমে চলতি মাসে ৫০ লাখ পরিবারকে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। এর বাইরে কয়েক দিনের মধ্যে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি আসছে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসনের দায়িত্ব আরো বাড়ছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এরই মধ্যে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ অনেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। কাজের গতি যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে জন্য দুটি শিফটে ভাগ করে দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে।

নীলফামারীর একজন এসি ল্যান্ড ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশ, ডাক্তারদের আক্রান্ত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে যেভাবে আসছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিষয়টি সেভাবে আসছে না। অন্যদের তথ্য জানানোর জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ফোকাল পয়েন্ট আছে। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডাররা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেও নিজেদের তথ্যগুলো গণমাধ্যমে তুলে ধরার মতো কেউ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *