ঈদুল আজহা : ত্যাগের মহিমায় গৌরবান্বিত এক দিন

অনলাইন ডেস্ক :

 

রাত পোহালেই পালিত হবে মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় দুটি উৎসবের একটি, পবিত্র ঈদুল আজহা। ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই পবিত্র দিনে পশু কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি খুঁজবেন মুসলমানেরা। মুসলিম উম্মাহর এই উৎসব ঘিরে ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। বাঙালি সমাজে কুরবানির ঈদ নামেও পরিচিত মুসলমানদের এই অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব।

 

পবিত্র ঈদুল আজহার ইতিহাস

 

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় গেলেন, তখন সেখানে জাহেলি যুগ থেকে প্রচলিত দুটি উৎসবের দিন ছিল; শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘মেহেরজান’।

 

রাসূল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, এই দুই দিন কীসের? মদিনাবাসী সাহাবিরা বললেন, জাহেলি যুগ থেকে আমরা এই দুই দিন খেলাধুলা ও আনন্দ করি। রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহ এই দুই দিনের বদলে তোমাদের নতুন দুটি উৎসবের দিন দিয়েছেন: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। (মুসনাদে আহমদ ১৩০৫৮)।

 

এভাবে মুসলমানদের পৃথক উৎসবের সূচনা হলো। এটা দ্বিতীয় হিজরি অর্থাৎ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনা। রাসুল (সা.) ঘোষণা করলেন, ‘সব জাতিরই ঈদ বা উৎসবের দিন থাকে, এটা আমাদের ঈদ।’ (সহিহ বুখারি ৩৯৩১, সহিহ মুসলিম ২০৯৮)।

 

কুরবানির ইতিহাস

 

ঈদুল আজহার দিনটি আল্লাহর প্রিয় বান্দা নবী ইব্রাহীম (আ.)-এর তাকওয়া ও আনুগত্যের স্মারক। ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে দেখেছিলেন তিনি তার ছেলেকে কুরবানি দিচ্ছেন। এটাকে তিনি আল্লাহর নির্দেশ মনে করেন এবং ছেলেকে কুরবানি করতে নিয়ে যান। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় ছেলের বদলে একটি পশু কুরবানি করা হয়। এই ঘটনা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফেরা করার মতো বয়সে উপনীত হলো তখন ইব্রাহীম বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে তোমাকে আমি কুরবানি করছি, এখন তোমার অভিমত কি বলো। সে বলল, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইব্রাহীম তার পুত্রকে কাত করে শায়িত করলো, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, ‘হে ইব্রাহীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছো। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কোরবানির বদলে।” (সুরা সাফফাত, আয়াত ১০২-১০৭)

 

যে দিন ইব্রাহীম (আ.) তাঁর ছেলে ইসমাইলকে কুরবানি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই দিনটিকেই আমরা ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ হিসেবে পালন করি। প্রতি বছর দিনটি আমাদেরকে আল্লাহর নিঃশর্ত আনুগত্য ও ত্যাগ তিতিক্ষার শিক্ষা দিয়ে যায়। পাশাপাশি এটি উৎসব ও আল্লাহর আতিথেয়তার দিন। আল্লাহর জন্য কুরবানি করে ওই পশুর গোশত আল্লাহর মেহমান হিসেবে আমরা খাই। কুরআনে আল্লাহ কুরবানির পশুর গোশত নিজে খেতে ও দরিদ্রদের খাওয়াতে বলেছেন। (সুরা হজ, আয়াত: ২৮)

 

কেন কুরবানি দেওয়া হয়? এর বিধান কী?

 

পবিত্র ঈদুল আজহায় কুরবানি গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর কুরবানি ওয়াজিব। এদিকে কুরবানি শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ হল নৈকট্য, সান্নিধ্য, আত্মত্যাগ, জবেহ, রক্তপাত ইত্যাদি।

 

ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় কুরবানি বলা হয়- মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় নির্ধারিত তারিখের মধ্যে হালাল কোনো পশু আল্লাহর নামে জবেহ করা।

 

কুরবানি নতুন কোনো প্রথা নয় বরং এটা আদিকাল থেকে চলে আসছে। হযরত আদম (আ.) এর যুগে কুরবানির সূচনা হয়েছিল। আদম (আ.)-এর সন্তান হাবিল-কাবিলের মধ্যে বিবাহ-শাদি নিয়ে যখন মতানৈক্য দেখা দিল, তখন আল্লাহতায়ালা তাদের ইখলাসের সঙ্গে হালাল পশু কুরবানি করার নির্দেশ দিলেন।

 

তিনি বললেন- তোমাদের মধ্যে যার কুরবানি আমার নিকট কবুল হবে তার কাছে মেয়ে বিবাহ দেয়া হবে। হাবিল এবং কাবিল কুরবানির নির্দেশ পেয়ে কুরবানি করল।

 

হাবিলের কুরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হল, কাবিলেরটা হল না। কাবিলের কুরবানি কবুল না হওয়ার কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে হাবিলকে বলল আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব।

 

এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন- হে নবী আপনি তাদের নিকট যথাযথভাবে আদম (আ.)-এর পুত্রদ্বয়ের কথা আলোচনা করেন, যখন তারা মহান রবের নিকট তাদের কুরবানিকে পেশ করল, তখন একজনের কবুল হল অন্যজনের হল না।

 

যার কুরবানি কবুল হল না সে ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যজনকে বলল আমি তোমাকে খুন তথা হত্যা করে ফেলব। পালনকর্তা একমাত্র মুত্তাকীদের কুরবানি কবুল করেন (সূরা মায়িদা: ২৭)।

 

কুরবানির গুরুত্ব প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন কুরআন কারিমে এরশাদ করেন- আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানি নির্ধারণ করেছি; যাতে তারা হালাল পশু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে (সূরা হজ: ৩৪)।

 

আল্লাহতায়ালা কুরআনে আরও বলেছেন- নিশ্চয়ই আমার নিকট কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই কবুল হয় না, তবে আমার নিকট পৌঁছে একমাত্র তাকওয়া (সূরা হজ: ৩৭)।

 

একদা হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) রাসুলের (সা.) নিকট জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) কুরবানি কী?

 

উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করলেন- কুরবানি হচ্ছে তোমাদের আদি পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনাদর্শ। সাহাবি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন- কুরবানির ফজিলত কী?

 

রাসুল (সা.) বললেন, পশুর পশমের পরিবর্তে একেকটি করে নেকি দেয়া হয় (মেশকাত: ১২৯)।

 

হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই কুরবানিদাতার কুরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় এবং তার অতীতের সকল গুনাহ মোচন করে দেয়া হয় (তিরমিজি: ১/১৮০)।

 

মহানবী (সা.) আরও এরশাদ করেন, তোমরা মোটাতাজা পশু দেখে কোরবানি কর, কারণ এ পশুই পুলসিরাতের বাহক হবে (মুসলিম: ২৬৩৯)।

 

বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল (সা.) পবিত্র মদিনায় দশ বৎসর জীবনযাপন করেছেন। প্রত্যেক বছরই তিনি পশু কুরবানি করেছেন (তিরমিজি: ১/১৮৯)।

 

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- কুরবানির দিন আল্লাহর নিকট কুরবানি অপেক্ষা উত্তম কোন আমল আর নেই (মেশকাত: ১৯৩৭)।

 

বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন- সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানির দিন কুরবানি করে না, সে যেন ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহের ময়দানের কাছে না যায় (ইবনে মাজাহ: ১৭২১)।

 

ঈদুল আজহার সামাজিক তাৎপর্য

 

ঈদুল আজহা উদযাপনে পশু উৎসর্গের মধ্যে রয়েছে বিশেষ আর্থসামাজিক তাৎপর্য। হযরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক পুত্র ইসমাইল (আ.)কে আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার ইচ্ছা প্রকাশের মহান স্মৃতিকে স্মরণ করে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কুরবানি মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে নিজের পাশব প্রবৃত্তি, অসৎ উদ্দেশ্য ও হীনম্মন্যতাকেই কুরবানি করা হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই বিশেষ ঈদ উৎসবে নিজের চরিত্র ও কুপ্রবৃত্তিকে সংশোধন করার সুযোগ আসে। জীবজন্তু উৎসর্গ করাকে নিছক জীবের জীবন সংহার হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি আত্মশুদ্ধি ও নিজের পাশব প্রবৃত্তিকে অবদমন প্রয়াস প্রচেষ্টারই প্রতীকী প্রকাশ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিবেচনায়, ‘আজ আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের মত পূত বোধন/ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।’

 

সামাজিক কল্যাণ সাধনে সংশোধিত মানবচরিত্র বলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কুরবানির মাংস গরিব আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করার যে বিধান তার মধ্যে নিহিত রয়েছে সামাজিক সমতার মহান আদর্শ।

 

ঈদুল আজহার শিক্ষা

 

ইসলাম ভোগবাদে বিশ্বাসী নয়। ত্যাগের মহিমায় পরম স্রষ্টার আনুগত্যের সামনে অবনত মস্তকে নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত কল্যাণ। কুরবানির বিধান বাস্তবায়নে মহান আল্লাহর নির্দেশনার প্রতিফলন ঘটে এবং এরই মধ্য দিয়ে সত্যিকার অর্থে চিত্ত আর বিত্তের সমন্বয়ে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠুক ঈদুল আজহা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *