ন্যাশনাল ডেস্ক: রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে পানগাঁও পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর দুই তীরের প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশে দখলদার রয়েছেন ১৭৫ জন। তাঁরা নদী ও নদীতীরের ৪০ একরের বেশি জায়গা দখল করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। এসব স্থাপনার মধ্যে ৩৩টি ডকইয়ার্ডও (নৌযান নির্মাণ ও মেরামত কারখানা) রয়েছে। দখলদারদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির দুজন সাংসদ রয়েছেন। এই তথ্য সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)।
বুড়িগঙ্গা নদী ও তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে গত ২৯ জানুয়ারি থেকে অভিযান শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট চার দিনের অভিযানে কামরাঙ্গীরচর, নবাবচর ও খোলামোড়া এলাকায় চার শতাধিক বড় স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি সাততলা, ছয়তলা একটি ভবনের একাংশ, দুটি দোতলা ও তিনটি একতলা ভবনও রয়েছে। এসব ভবনের বেশির ভাগ নদী ও তীরের জায়গা দখল করে তৈরি করা হয়েছিল।
বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দখলদারদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত সাত একরের বেশি জায়গা উদ্ধার করা হয়েছে। বুধ (আজ) ও বৃহস্পতিবারও অভিযান চলবে। তিনি বলেন, নদীর ঢাল থেকে ১৫০ ফুট অংশ নদীর। তিনি বলেন, যেসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে, সেগুলোর মালামাল নিলামে তোলা হবে। নদীর সব জায়গা উদ্ধারের পর সীমানাখুঁটি বসানো হবে।
বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও ধলেশ্বরী নদ-নদীতীরের উদ্ধার করা জায়গায় ৫০ কিলোমিটার হাঁটার পথ (ওয়াকওয়ে) ও সবুজ চত্বর তৈরি করা হবে বলে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানান। তাঁরা বলেন, বুড়িগঙ্গার পর পর্যায়ক্রমে অন্য নদীগুলোতে অভিযান চলবে।
বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী কামরাঙ্গীরচরে নদী দখলের তালিকায় ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজি মো. সেলিমের মালিকানাধীন মদীনা ট্রেডিংয়ের নাম রয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি মদীনা ট্রেডিংয়ের বিক্রয়কেন্দ্র, গুদাম ও মদীনা স মিল ভেঙে দেওয়া হয়।
মদীনা গ্রুপের ব্যবস্থাপক সাধন চন্দ্র সরকারের দাবি, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নামে কেনা জায়গা ভেঙে দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
বিআইডব্লিউটিএর তালিকা অনুযায়ী নদীর জায়গা দখল করে ৩৩টি ডকইয়ার্ড রয়েছে। এর বেশির ভাগ সদরঘাট নৌ টার্মিনালের বিপরীতে মিরেরবাগ ও চরমিরেরবাগ এলাকায়। ডকইয়ার্ড রয়েছে জাতীয় পার্টির সাংসদ গোলাম কিবরিয়া, কার্গো লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হোসেন এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের (দক্ষিণ) সভাপতি আবুল হাসনাতের। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, কোনো ডকইয়ার্ডেরই অনুমোদন নেই।
গত সোমবার দুপুরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মিরেরবাগ এলাকায় কথা হয় নৌকার মাঝি রশিদ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ডকইয়ার্ডে মেরামতের অপেক্ষায় থাকা লঞ্চের জন্য নদীর জায়গা কমে গেছে। নদীর এই অংশের পানি কালো ও তৈলাক্ত। লঞ্চ মেরামতের সময় নদীতে পোড়া তেল ফেলা হয় বলে স্থানীয় দোকানি ও মাঝিরা জানান।
মিরেরবাগে রয়েছে জাতীয় পার্টির নেতা বরিশাল-৩ আসনের সাংসদ গোলাম কিবরিয়ার ডকইয়ার্ড। যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নদীর জায়গা দখল করে ডকইয়ার্ড তৈরির প্রশ্নই ওঠে না। বিআইডব্লিউটিএ যদি প্রমাণ করতে পারে যে এই জমি নদীর, তাহলে তাঁর কিছু বলার নেই। তাঁর দাবি, সাবেক একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে তাঁর ডকইয়ার্ডের নাম দখল তালিকায় উঠেছে।
কার্গো লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি ইকবাল হোসেনের মালিকানাধীন বিসমিল্লাহ ডকইয়ার্ড নদীতীরের চরমিরেরবাগে। বিআইডব্লিউটিএর দাবি, এই ডকইয়ার্ড নদীর প্রায় ১৯ শতাংশ জায়গা দখল করেছে। জানতে চাইলে ইকবাল হোসেন বলেন, সরকার যদি মনে করে তাঁর ডকইয়ার্ডের জায়গা নদীর, তাহলে নিয়ে যেতে পারে। তবে আগে ডকইয়ার্ডের জন্যও নদীপাড়ে অন্য কোনো স্থান বরাদ্দ করে দিতে হবে।
আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবুল হাসনাতের মালিকানাধীন বায়োজিদ ডকইয়ার্ড মিরেরবাগে। তাঁর দাবি, জায়গার মালিকানার কাগজপত্র রয়েছে। তবে বিআইডব্লিউটিএ বলছে, নদীর ২৪ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়ে ডকইয়ার্ড করা হয়েছে।
নদী দখল করা ব্যক্তিদের ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জাতীয় সংসদসহ সব ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করে গত রোববার রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, এ ধরনের অপরাধে জড়িত ব্যক্তি ব্যাংকঋণ পাবেন না। একই সঙ্গে রায়ে দেশের নদ-নদী রক্ষায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে অভিভাবকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বুড়িগঙ্গার জায়গায় ৩৩টি ডকইয়ার্ড গড়ে তোলার বিষয়ে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, প্রয়োজনে অন্যত্র জায়গা অধিগ্রহণ করে এসব ডকইয়ার্ড সরানোর বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই ওই জায়গায় ডকইয়ার্ড রাখা যাবে না।