

অনলাইন ডেস্ক :
মোদির প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট মরিয়া হয়ে লড়লেও জনমত জরিপে মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট বেশ এগিয়ে আছে।
ভারতীয় আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভার ১৮তম নির্বাচন এবার বেশ তিক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিরোধীরা বলছে, প্রচারণার সমান সুযোগ থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, বিজেপি সরকারের পরামর্শে বিরোধী নেতাদের স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলো।
কংগ্রেসের ভাষ্য, কর কর্তৃপক্ষ ভোটের আগে আগে তাদের ব্যাংক হিসাব ছয় সপ্তাহের জন্য জব্দ করে রাখায় নির্বাচনী প্রচারণা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালসহ বেশ কয়েকজন বিরোধীদলীয় নেতা দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে বন্দি। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন বিরোধীরা। তবে নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচন কমিশন আইনের সংশোধনীর ফলে এর স্বাধীনতা নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে ৯৬ কোটি ৯০ লাখ ভোটার। আজ থেকে শুরু হয়ে আগামী ১ জুন পর্যন্ত মোট সাত ধাপে লোকসভার ৫৪৩টি আসনে ভোট হবে। আগামী ২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় ধাপে ৮৮টি, ৭ মে তৃতীয় ধাপে ৯৫টি, ১৩ মে চতুর্থ ধাপে ৯৬টি, ২০ মে পঞ্চম ধাপে ৪৯টি, ২৫ মে ষষ্ঠ ধাপে ৫৭টি এবং ১ জুন সপ্তম ধাপে ৫৭টি আসনে ভোট হবে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, প্রথমবারের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ ও বিকলাঙ্গ ব্যক্তিরা বাড়ি থেকে ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন। দেশজুড়ে প্রায় ১৫ লাখ ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্র স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারে স্থাপন করা হয়েছে। তবে পাহাড়ের চূড়া ও জঙ্গলের মতো দুর্গম স্থানেও রয়েছে ভোটকেন্দ্র।
যেসব রাজ্যে ভোট
প্রথম ধাপে আজ ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১০২টি আসনে ভোট হবে। এর মধ্যে তামিলনাড়ুর ৩৯টি আসনের সবকটিতে ভোট হবে। এ ছাড়া রাজস্থানের ২৫টির মধ্যে ১২টি; উত্তর প্রদেশের ৮০টির মধ্যে আটটি; মধ্য প্রদেশের ২৯টির মধ্যে ছয়টি; মহারাষ্ট্রের ৪৮টির মধ্যে পাঁচটি; উত্তরাখণ্ডের পাঁচটির সব কটি; আসামের ১৪টির মধ্যে পাঁচটি; বিহারের ৪০টির মধ্যে চারটি; পশ্চিমবঙ্গের ৪২টির মধ্যে তিনটি; অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর ও মেঘালয় রাজ্যের দুটির সব কটি; ছত্তিশগড়ের ১১টির মধ্যে একটি; মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও সিকিমের একমাত্র আসন; ত্রিপুরার দুটির মধ্যে একটি; জম্মু ও কাশ্মীরের পাঁচটির মধ্যে একটি এবং কেন্দ্রশাসিত আন্দামান নিকোবর, লাক্ষাদ্বীপ ও পুদুচেরির একমাত্র আসনে ভোট হবে।
ভারতের ভোটের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় ২৪ কোটি অধিবাসীর উত্তর প্রদেশকে। দেশের সবচেয়ে জনবহুল এই রাজ্য থেকে সবচেয়ে বেশি এমপি (৮০) পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেন। ভারতের আটজন প্রধানমন্ত্রীর শিকড় এই রাজ্যেই।
বিশ্লেষকদের ভাষ্য, দিল্লির রাস্তা উত্তর প্রদেশ হয়ে যায়। অর্থাত্ যে দল উত্তর প্রদেশে ভালো ফলাফল করে, তারাই মূলত দিল্লির মসনদে বসে। আজ এখানে অবশ্য মাত্র আট আসনে ভোট।
আলোচনার কেন্দ্রে যথারীতি মোদি
এবারের নির্বাচনেও সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তির নাম নরেন্দ্র মোদি। জনমত জরিপ ও অনেক বিশ্লেষকের পর্যবেক্ষণ বলছে, টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে চলেছেন তিনি। আর এমনটা হলে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর রেকর্ডে ভাগ বসাবেন তিনি।
জাতির মধ্যে কিছু মেরুকরণ ঘটানো এবং সরকারের অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও ভারতে মোদির ম্যাজিকসুলভ জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। সুশাসন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভারতের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মোদিকে কৃতিত্ব দেন তাঁর কোটি কোটি সমর্থক। অন্যদিকে সমালোচকরা বলেন, মোদির কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের ঠাঁই নেই। তিনি ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান পাল্টে দিতে চান। তবে যে যাই বলুন, ৮০ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর দেশে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের যে কৌশল মোদি নিয়েছেন, তা সফল হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে মোদির স্লোগান, ‘আবকি বার, চার শ পার (এবার চার শর বেশি আসনে জিতব)।’ বিজেপি নিজের ও মিত্রদের জন্য এই লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে ২৭২টি আসন প্রয়োজন। গত নির্বাচনে ৩০৩টি আসনে জয় পায় বিজেপি।
অন্য যাঁরা আলোচনায়
মোদির নির্বাচনী প্রচারণায় অন্যতম মাত্রা যোগ করা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চলেছেন। বিজেপির অতীতের সফলতায়ও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সমর্থকরা বলেন, অমিত হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করছেন।
অন্যদিকে সমালোচকরা বলেন, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব আইনের মতো বিতর্কিত আইন উপস্থাপনের পেছনে তিনিই কলকাঠি নেড়েছেন। এবারের নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও বেশ আলোচিত ব্যক্তিত্ব।
পাদপ্রদীপের আলোয় আছেন অন্যতম বিরোধী নেতা কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীও। তাঁর প্রপিতামহ, দাদি ও বাবা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত এক দশকে বিজেপির উত্থানে সংকুচিত হয়েছে কংগ্রেস যার দায় অনেকটাই রাহুলের কাঁধে পড়েছে। দলের সুদিন ফিরিয়ে আনতে দুটি বড় পদযাত্রা করেছেন এই কংগ্রেস নেতা।
এর বাইরে বিরোধীদের মধ্যে যে নেতা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল। সমর্থকদের আশঙ্কা, কেজরিওয়াল কারাবন্দি থাকায় দলের প্রচারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আলোচনায় যেসব ইস্যু
নির্বাচনের আগে বেশ কিছু বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে। নতুন রাম মন্দির নির্মাণ কি মোদির তুরুপের তাস হবে; অর্থনীতি, চাকরি বা কল্যাণ প্রকল্প কি ভোটারদের অগ্রাধিকার; নাকি জাত বা ধর্মের নামে ভোট দেবেন তারা?
উত্তর ভারতের অযোধ্যায় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রামের মন্দির নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে মোদি বড় ধরনের সুবিধা পেতে যাচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নির্বাচনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে অর্থনীতি। ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার যে অঙ্গীকার মোদি করেছেন, তা কি ভোটারদের মন গলাতে পারবে সেটা অনেকেই দেখার অপেক্ষায়। গত বছর যুক্তরাজ্যকে হটিয়ে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয় ভারত। তবে অর্থনীতিতে চমকপ্রদ উত্থান সত্ত্বেও ভারতে এখনো অনেক ক্ষেত্রেই অসমতা রয়ে গেছে। মাথাপিছু আয়ে ভারতের অবস্থান বিশ্বে ১৪০তম এবং প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। চাকরি নিয়েও ভোটারদের মনে শঙ্কা রয়েছে।
সূত্র: বিবিসি, এএফপি