অনলাইন ডেস্ক: চলতি মাসে বেশ বেকায়দায় পড়ে গেছে পাকিস্তান। প্রতিবেশীরা দেশটির দিকে ‘সীমান্ত সন্ত্রাসে’র অভিযোগ তুলেছে। এর মধ্যে আছে ‘চিরশত্রু’ ভারতও। ইরান ও আফগানিস্তান এরই মধ্যে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে। আর ভারত দিয়েছে শাস্তি দেওয়ার হুমকি! কিন্তু আদতেই শেষ পর্যন্ত কী হবে?
১৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের দিকে প্রথম আঙুল তোলে ইরান। সেদিন এক গাড়িবোমা হামলায় ইরানের এলিট নিরাপত্তা বাহিনীর ২৭ জন সদস্য নিহত হয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আইআরএনএ বলছে, সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে চালানো ওই আত্মঘাতী হামলায় পাকিস্তানের মদদ রয়েছে। ওই অঞ্চলে অনেক দিন ধরেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আনাগোনা আছে। ইরানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দাবি, এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিচ্ছে পাকিস্তান। সীমান্তের ওপারেই এই হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং সীমান্ত অতিক্রম করে ইরানে ঢুকে হামলা চালানো হয়। ইরানের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ওই সব বিচ্ছিন্নতাবাদীকে নানা সহায়তা দিচ্ছে। যদি পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, তবে পাল্টা জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান।
এর পরদিনই বারুদের স্তূপে আগুন লাগে! ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক আত্মঘাতী হামলায় ভারতের আধা সামরিক বাহিনীর ৪০ সদস্য নিহত হন। এতে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর সম্পর্কের আগুনে নতুন করে ঘি পড়ে। শুরু হয়ে যায় ভারত-পাকিস্তানের কথার লড়াই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানের দিকে অভিযোগ তুলে বলে দিয়েছেন, এই হামলার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। উরি ঘটনায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালানোর ঘটনা ঘটেছিল নরেন্দ্র মোদির আমলেই। এবারের ঘটনায় মোদি সরকার নতুন কি পদক্ষেপ নেবে, তা নিয়ে এরই মধ্যে চাপানউতোর চলছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, যে পদ্ধতিতেই জবাব দেওয়া হোক না কেন, তা যে গতবারের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের তুলনায় কঠোর হবে—তেমনই বলা হচ্ছে।
এক রামে রক্ষা নেই, আবার সুগ্রীব দোসর! পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলার জন্য ইরান ও ভারতই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আফগানিস্তান তাতে বাড়তি ‘মসলা’ জুগিয়েছে। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে জাতিসংঘে এক অভিযোগ দাখিল করেছে আফগান সরকার। তাতে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন করছে পাকিস্তান। বর্তমানে জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবানের সঙ্গে বৈঠক করছে পাকিস্তান, উদ্দেশ্য শান্তি আনা। আর এই কর্মসূচিতে পাকিস্তানের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র। আফগান সরকারের অভিযোগ, একটি স্বাধীন দেশের সরকারকে পাশ কাটিয়ে সেই দেশেরই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালানো সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের শামিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবার এ ব্যাপারে পাকিস্তানের পাশেই আছেন।
পুরো চিত্রটি এমন দাঁড়িয়েছে যে, একের পর এক অভিযোগের নিচে প্রায় চাপা পড়তে চলেছে পাকিস্তান। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, এরই মধ্যে সন্ত্রাসবাদ ঠেকানোর প্রশ্নে ইরানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে ভারত। আমেরিকাও পরোক্ষভাবে নিয়েছে ভারতের পক্ষ। অন্যদিকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ভরসা হলো চীন, সঙ্গে আছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। তবে শেষের দুটি দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে নিমরাজি!
কথার লড়াইও থামছে না। এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, গতকাল শনিবার এক বক্তৃতায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেছেন, ‘ইমরান খান আমাকে বলেছিলেন, তিনি একজন পাঠান—সত্যি কথা বলেন এবং সত্যের পথে থাকেন। এবার তা প্রমাণ করার পালা।’ ওদিকে শুরু থেকেই ভারতের দোষারোপের নীতির বিরোধিতা করছেন ইমরান খান। তিনি বলেছেন, হামলার ঘটনা–সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ যদি ভারত দেয়, তবে অবশ্যই পাকিস্তান তাতে সহায়তা করবে।
জম্মু-কাশ্মীরে কথিত সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে ভারত। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও যুদ্ধংদেহী মনোভাবে চলে গেছে। ডন-এর খবরে প্রকাশ, গত শুক্রবার কাশ্মীরসংলগ্ন সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন শেষে দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়া বলেছেন, ভারতের পক্ষ থেকে কোনো আঘাত এলে এর সমুচিত জবাব দিতে প্রস্তুত রয়েছে তাঁর বাহিনী।
পাকিস্তানকে একঘরে করতে পারবে ভারত?
পুলওয়ামায় হামলার পর ভারতে ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে পাকিস্তানবিরোধিতা। এই দুই দেশের বৈরিতা চলছে জন্মলগ্ন থেকেই। এবার তা তীব্রতর হয়েছে। গণহারে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে বলিউডে কাজ করা পাকিস্তানের শিল্পীদের। কেউই এখন আর সহাবস্থানের কথা বলছেন না, এবার শাস্তি চান তাঁরা। কিন্তু বলা যতটা সহজ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির মারপ্যাঁচের কারণে তা করা ঢের কঠিন।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে রাষ্ট্রীয় মদদ দেওয়ার অভিযোগ বেশ পুরোনো। এই অভিযোগ সবচেয়ে বেশি তুলেছে পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোই; বিশেষ করে জইশ-ই-মোহাম্মদ, লস্কর-ই-তইবা ও তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের দহরম-মহরমের কথা সর্বজনবিদিত। জইশ-ই-মোহাম্মদ নেতা মাসুদ আজহারের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ উঠলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি পাকিস্তান। উল্টো ঠেকানো হচ্ছে মাসুদ আজহারকে ‘সন্ত্রাসী’ ঘোষণার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে জাতিসংঘে এ নিয়ে আওয়াজ উঠলেই পাকিস্তানের হয়ে চীন তাতে ভেটো দিয়ে দেয়। এই মাসুদ আজহারের বিরুদ্ধে আছে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা থেকে শুরু করে একাধিক সন্ত্রাসী হামলায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে ভারতের। ইকোনমিস্ট বলছে, অর্থনৈতিকভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে ভারত। এরই মধ্যে আমদানির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পণ্যের ওপর ২০০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। তবে এতে পাকিস্তানের ক্ষতি হওয়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। কারণ পাক-ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিধি বেশ ছোট, বছরে পাকিস্তান থেকে মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আনে ভারত।
বিবিসি বলছে, পাকিস্তানের তুলনায় ভারতের অর্থনীতি প্রায় সাড়ে আট গুণ বড়। সেদিক থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের প্রভাব পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স নামে একটি আন্তর্জাতিক আন্তসরকারব্যবস্থা আছে, যা মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের মতো বিষয়গুলো প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে পাকিস্তানকে কালো তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা চালাবে ভারত। এতে করে দেশটির মুদ্রাপ্রবাহ, স্টক মার্কেট ও ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রেও ভারতের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে চীনের ভেটো।
কূটনৈতিক দিক থেকে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে অবশ্য হোঁচট খেয়েছে ভারত। সম্প্রতি প্রথমে পাকিস্তান ও পরে ভারত সফর করেছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারত চেষ্টা করেছিল সন্ত্রাসী হামলার প্রসঙ্গে যেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন বিন সালমান। কিন্তু সৌদি যুবরাজ টুঁ শব্দ করেননি। দুই দেশকে হাতে রাখতে মধ্যপন্থা নিয়েছেন তিনি, উত্তেজনা কমাতে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবও দিয়েছেন।
পুলওয়ামায় হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ১৯ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তানের কাবুলে পাকিস্তানের দূত জানিয়ে দেন, পাকিস্তান যদি চাপে পড়ে তাহলে কেঁচে যেতে পারে তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা। আর এ কথাতেই চুপ করে গেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এখন আর এ নিয়ে বেশি কথা ওঠাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। কারণ ভারতকে সমর্থনের চেয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতেই তাদের বেশি মনোযোগ।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পুরোদমে ‘পানিযুদ্ধ’ শুরু করতে পারে ভারত। দেশটির যোগাযোগমন্ত্রী নিতীন গড়করি সম্প্রতি এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, সিন্ধু উপত্যকা দিয়ে বয়ে চলা নদীর পানির অভিমুখ পরিবর্তন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। সিন্ধু নদের পানির ওপর নির্ভরশীল পাকিস্তানের কোটি কোটি মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ জন্য ১৯৬০ সালে করা পানিচুক্তি থেকেও সরে আসতে হবে ভারতকে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে এখন পর্যন্ত এটিই ভারতের দেওয়া সবচেয়ে বড় হুমকি।
এসবের পর বাকি থাকল শুধু সামরিক উপায়। বিবিসি বলছে, দুটি দেশের হাতেই পরমাণু অস্ত্র থাকায়, এ ধরনের পদক্ষেপ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই সত্যটি পাক-ভারতের সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও জানেন। তাই সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলি বা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালালেও, কোনো দেশই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের দিকে এগোবে না; বরং পরমাণু অস্ত্র হাতে নিয়ে হম্বিতম্বি করার দিকেই দুই পক্ষের বেশি আগ্রহ। সাম্প্রতিক সময়ে মনুষ্যবিহীন উড়োজাহাজ ও বিভিন্ন প্রযুক্তি কেনার দিকে আগ্রহী হয়েছে ভারত। সীমান্ত সন্ত্রাস মোকাবিলায় এসব ব্যবহার করতে পারে দেশটি।
এদিকে ভারতে যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে বাজছে লোকসভা নির্বাচনের দামামাও। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনী হাওয়া নিজের দিকে নিতে চাইলে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর সে জন্য সময় আছে মোটে দুই মাস। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে কখনোই ভালো ফলাফল বয়ে আনে না। এখন দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা যে মাত্রায় পৌঁছেছে, তাতে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত যেকোনো পদক্ষেপ অসম্ভব কিছু নয়। তবে অবশ্যই বড় বাধা হয়ে থাকবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র।