কুষ্টিয়ায় অবৈধ যান তৈরির কারখানা বন্ধের উদ্যোগ

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : উচ্চাদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কুষ্টিয়া জেলা থেকে সব ধরনের অবৈধ যান তৈরির কারখানা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা পুলিশ। ইতিমধ্যে জেলার সব নসিমন, করিমন ও ভটভটি তৈরির কারখানা মালিকদের ডেকে সময় বেঁধে দিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। না মানলে কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে অবৈধ যানবাহন তৈরির অভিযোগ ও মহাসড়কে চালানোর অভিযোগে মামলাসহ জরিমানা এমনকি কারখানা সিলগালা করে দেয়া হবে বলে জানা গেছে। পুলিশের এ উদ্যোগে মালিকরা নাখোশ হলেও খুশি সাধারণ মানুষ। নসিমন, করিমন ও ভটভটির কারণে প্রতি বছর জেলায় সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। দেশের সব থেকে বড় অবৈধ যানবাহন তৈরির কারখানা কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ভাদালিয়ায় অবস্থিত। যার মালিক আব্দুর রশিদ নামের এক ব্যক্তি। যিনি অবৈধ যানবাহন তৈরি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ভাদালিয়া বাজারেই নসিমন করিমন, ভটভটি ও ইঞ্জিন চালিত ভ্যান তৈরির অনেকগুলো কারখানা রয়েছে। পুরো জেলায় শতাধিক অবৈধ যানবাহন তৈরির কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রতি মাসে শতশত নসিমন, করিমন ভটভটি তৈরি হচ্ছে। চীন থেকে স্যালো ইঞ্জিন এনে কোন প্রযুক্তি ছাড়াই নিজেদের মত যানবাহন তৈরি করে বাজারজাত করা হচ্ছে। এমনকি ছোট ছোট ট্রাক তৈরি করা হচ্ছে এসব কারখানায়। যা অত্যন্ত বিপদজনক।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, জেলায় তারা ৭০টি কারখানা খুঁজে পেয়েছেন। এসব কারখানা মালিকদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে। সবাইকে ডেকে এক মাসের আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। না মানলে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে আব্দুর রশিদ বলেন, জেলায় সব মিলিয়ে ছোট বড় শতাধিক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় উৎপাদন চলছে। পুলিশ সুপার ডেকে এক মাসের মধ্যে কারখানা বন্ধ করতে বলেছে। আমরা দুই মাস সময় চেয়েছিলাম।’
এর আগে পুলিশ ও জেলা প্রশাসন থেকে এ সব কারখানসহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হলেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক দলের কিছু সুবিধাবাদী নেতা। যারা প্রতিমাসে এসব কারাখানা থেকে মাসোহারা পান। এখনো এসব নেতাদের অনেকেই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন।
নসিমন চালক ও মালিকরা জানান, ‘গ্রামীণ সড়কে তাদের চলাচলের অনুমতি আছে। তবে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে মহাসড়কে যানবাহন চালানো যাবে না। তারপরও তারা ম্যানেজ করে চলেন। প্রতিটি গাড়ি থেকে সমিতির নেতারা ৪০০ টাকা করে নেন প্রতি মাসে। নেতারা এসব অর্থ দিয়ে হাইওয়ে পুলিশসহ নেতাদের ম্যানেজ করেন। তাদের কুপন দেয়া হয়। সেই কুপন দিয়ে তারা অবাধে চলতে পারেন। তবে অনেক সময় বাইরের জেলায় গেলে ঝামেলা হয়।
ভাদালিয়া এলাকায় অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এ এলাকায় নব্বইয়ের দশকে প্রথমে নসিমন কারখানা স্থাপন করে বাই সাইকেলের মিস্ত্রী ও যত্রাংশ বিক্রেতা আব্দুর রশিদ। তিনি স্যালো ইঞ্জিন দিয়ে তিন চাকার যান তৈরি করেন। যার নাম দেওয়া হয় নসিমন। নসিমনে যাত্রী পরিবহন করা হয়। ওপরে ছাউনি থাকার কারণে এর নাম দেয়া হয় নসিমন। আর একইভাবে করিমন তৈরি করা হয়। ছাউনি না থাকায় মালামাল পরিবহন করা হয় এ যানবাহনে। গ্রামঞ্চালের মানুষের কাছে এসব যানবাহন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে মহাসড়ক গুলোতে বাড়তে থাকে দুর্ঘটনা।
আব্দুর রশিদের একাধিক কারখানা রয়েছে। তিনি নিজেই যন্ত্রাংশ তৈরি করেন। তার কারখানায় অবৈধভাবে ছোট ছোট ট্রাক তৈরি করা হচ্ছে। একইভাবে এ বাজারে অন্য বেশ কয়েকজন মালিক অবৈধ যানবাহন তৈরি করছেন।
এক সময় রশিদের কোন অর্থ সম্পদ না থাকলেও এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। একাধিক কারখানা, গাড়ি, বাড়িসহ হাড়ি পাতিল তৈরির কারখানাও করেছেন। শহরেও কিনেছেন ফ্লাট ও বাড়ি। দেড় যুগে তিনি বাজিমাত করেছেন।
তার মত অনেকেই অবৈধ যানবাহন কারখানা করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ করেছেন। যারা সরকারকে কোন রাজস্ব দেন না। সরকার কোন সুফল পাই না। এমনকি যারা গাড়ি চালাচ্ছে তাদেরও নেই কোন অভিজ্ঞতা। এমনকি ট্রাফিক আইনও জানেন না এসব চালক।
এদিকে গত সপ্তাহে রশিদসহ অন্য মালিকদের ডাকেন পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত। তিনি মাস খানেকের আল্টিমেটাম দেন কারখানায় অবৈধ যানবাহন বন্ধের বিষয়ে। এ সময়ের মধ্যে বন্ধ না হলে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার হুশিয়ারি দেন তিনি।
কুষ্টিয়া বাস মিনিবাস মালিক গ্রুপের কার্যকরী সভাপতি আতাহার আলী বলেন, ‘সড়কে শতশত অবৈধ নসিমন করিমন চলছে। যার ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে নসিমন করিমনের কারণে। তাই যানবাহন বন্ধের আগে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে। পুলিশ যে উদ্যোগ নিয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা প্রয়োজনে সহযোগিতা করব।’
ভাদালিয়া থেকে এসব কারখানা ছড়িয়ে পড়েছে সারা জেলায়। সব মিলিয়ে শতাধিক কারখানা আছে জেলার বিভিন্ন স্থানে। এসব কারখানা থেকে অবৈধ যানবাহন ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। তাই কারখানা বন্ধের ওপর জোর দেয়ার দাবি বাস মালিকসহ যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতাদের।
পুলিশের আল্টিমেটাম পাওয়ার পর অবৈধ যানবাহন মালিকরা যান স্থানীয় সাংসদ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের কাছে। তিনিও কারখানা বন্ধের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত বলেন,‘ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আসে মহাসড়কে কোন অবৈধ যানবাহন চলবে না। সেই নির্দেশনার আলোকে সব অবৈধ যানবাহন কারখানা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারখানা বন্ধ হলে গাড়ি আর বাড়বে না। এসব কারখানার কোন অনুমোদন নেই। কোন প্রযুক্তি ছাড়াই নিজেদের মন মত করে এসব যানবাহন তৈরি হচ্ছে। যার ফলে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে। এক মাসের মধ্যে সব কারখানা বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্দেশ অমান্যকারিদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়া হবে। কোন তদবির সহ্য করা হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *