যুবরাজ সালমান লোকটি কেমন ?

অনলাইন ডেস্ক : মোহাম্মদ বিন সালমান ছিলেন সৌদি বাদশাহের ১৩ জন পুত্রের একজন। সৌদি আরবে আনুমানিক প্রায় ৫ হাজার যুবরাজের মতো তারও প্রাথমিক জীবন কেটেছে অভাবনীয় আরাম-আয়েশ আর বিলাসিতার মধ্যে। রিয়াদের মাদহার এলাকায় প্রাসাদে বড় হন তিনি। তার চারপাশে থাকতো ভৃত্য, রাঁধুনি, ড্রাইভার এবং অন্য কর্মচারীর দল, অনেকেই অন্য দেশ থেকে আসা। তার গৃহশিক্ষকদের একজন রশিদ সেক্কাই বলেছেন, তাকে প্রতিদিন একজন ড্রাইভার এসে বাড়ি থেকে প্রাসাদে নিয়ে যেতো।

তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে অন্য যুবরাজদের মতো ব্রিটেনে বা আমেরিকায় না গিয়ে কিং সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। এতে তিনি ঐতিহ্যানুগ ‘দেশের ছেলে’ হয়ে বেড়ে উঠেছেন। অনেক দিন পর্যন্ত তিনি ভালো ইংরেজিও বলতে পারতেন না। সৌদি আরবে একজন পুরুষের চারজন পর্যন্ত স্ত্রী থাকার অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মোহাম্মদ বিন সালমানে স্ত্রী মাত্র একজন। তিনি তার সম্পর্কীয় বোন প্রিন্সেস সারা বিনতে মাশুর বিন আবদুলআজিজ আল সউদকে বিয়ে করেছেন। তাদের দুই ছেলে, দুই মেয়ে। তার নিজ পরিবারকে এমবিএস একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে রেখেছেন।

তার পিতা তাকে ধীরে ধীরে ক্ষমতার জন্য তৈরি করেছেন, দেখিয়েছেন রিয়াদের গভর্নর হিসেবে কিভাবে বিবাদ মেটাতে হয়, সমঝোতা করতে হয়, সৌদি শাসনকাজ চালানোর কৌশল কী। এর পর পদোন্নতি পেতে পেতে তিনি হন একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী। আর ২০১৫ সালে বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর তার পিতা সালমান ৮০ বছর বয়েসে বাদশাহ হবার পরই তিনি এমবিএসকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং রাজসভার মহাসচিব নিয়োগ করেন।

এ সময় এমবিএসের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত ছিল ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের যুদ্ধ পরিচালনা – যা এখন এক রক্তাক্ত দীর্ঘ সংঘাতে পরিণত হয়েছে। এর আসল লক্ষ্য ছিল ইয়েমেনে সৌদি সমর্থক সরকারকে ক্ষমতায় রাখা, এবং হুতিদের পেছনে সমর্থনদাতা ইরানকে একটা শক্ত বার্তা দেয়া। ইয়েমেন এখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে।

সৌদিতে ২০১৭ সালে এক রক্তপাতহীন প্রাসাদ অভ্যুত্থান ঘটে যায়। বাদশাহ সালমান তখনকার যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ডেকে পাঠান এবং তাকে বলা হয় পদত্যাগ করতে – নতুন যুবরাজ হন মোহাম্মদ বিন সালমান। মোহাম্মদ বিন নায়েফ ছিলেন আমেরিকানদের আস্থাভাজন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সন্ত্রাসদমনের প্রধান হিসেবে আল-কায়দার বিদ্রোহী তৎপরতা দমনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।
সৌদি আরবে রাজার ক্ষমতা প্রশ্নাতীত, চূড়ান্ত। তাই তিনি যখন এমবিএসকে যুবরাজ অর্থাৎ তার উত্তরাধিকারী বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন মোহাম্মদ বিন নায়েফের মঞ্চ থেকে সম্পূর্ণ বিদায় নেয়া ছাড়া আর কোন পথ থাকলো না।

এর পর এমবিএস যা করলেন তা সারা দুনিয়ার আলোচিত বিষয়ে পরিণত হলো। তিনি ২০১৭ সালের নভেম্বরে ২০০ জন প্রিন্স, ব্যবসায়ী এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ লোককে গ্রেফতার করে কোন অভিযোগ ছাড়াই তাদের রিয়াদের রিৎজ কার্লটন হোটেলে আটকে রাখলেন। একে বলা হলো দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, আটকদের বলা হলো মুক্তি পেতে হলে তাদের শত শত কোটি রিয়ালের দুর্নীতিলব্ধ অর্থ রাজকোষে দিতে হবে। সমালোচকরা বলেন, এটা আসলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ছিল না – এটা ছিল এমবিএসকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন এমন যে কাউকে নিষ্ক্রিয় করা।

বাদশা আবদুল্লাহর দিকে রাজপরিবারের যে শাখা – সেখানকার প্রিন্সদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হলো। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে সশস্ত্রবাহিনী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ন্যাশনাল গার্ড – তিন সংস্থারই নিয়ন্ত্রণ আনা হলো এমবিএসের হাতে। তার হাতে তখন সর্বৈব ক্ষমতা।

ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের বিমান হামলায় হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে, শত শত লোক বন্দী হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের অনেকের সমর্থন সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে চলে যায় একজন সাংবাদিকের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। জামাল খাসোগি ছিলেন একজন সুপরিচিত লেখক এবং এমবিএসের কড়া সমালোচক। গত বছর ২রা অক্টোবর দুপুর বেলা তিনি তার বিবাহবিচ্ছেদের কাগজপত্র সংগ্রহ করতে ইস্তুাম্বুলের লেভেন্ট এলাকায় সৌদি কনস্যুলেটে ঢুকেছিলেন।

ঢোকার কিছু পরই রিয়াদ থেকে পাঠানো একদল নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা এজেন্ট তাকে হত্যা করে, তার মৃতদেহ কেটে টুকরো টুকরো করে কোথাও নিয়ে যায় – যার কোন হদিশই পাওয়া যায়নি। যদিও সরকারিভাবে সৌদি আরব তা অস্বীকার করেছে, কিন্তু পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে যে খাসোগজির মুখ বন্ধ করার এই অপারেশনের ব্যাপারে এমবিএস অন্তত আগে থেকেই জানতেন।সিআইএ মনে করে – তিনিই হত্যাকাণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসে এক সাক্ষাৎকারে যুবরাজ এ ঘটনার ‘দায়িত্ব’ নিয়েছেন কিন্তু তার জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।

তবে এই ঘটনার পেছনে একজন মূল সন্দেহভাজন হচ্ছেন এমবিএসের ঘনিষ্ঠতম উপদেষ্টাদের একজন সাউদ আল-কাহতানি। খাসোগজি হত্যাকাণ্ডের পরপরই বাদশাহ সালমানের আদেশে তাকে বরখাস্ত করা হয়। বলা হয়, এমবিএসের নীতির কেউ বিরোধিতা করলে – তাদের ওপর নানাভাবে সাইবার নজরদারি ও হুমকির কার্যক্রমের পেছনে ছিলেন এই আল-কাহতানি। জামাল খাসোগজিও জানতেন, তিনি বিপদে আছেন।

আগে পশ্চিমা বিশ্বে এমবিএসকে এক দূরদর্শী সংস্কারক নেতা হিসেবে যেভাবে তুলে ধরা হতো – তার পরিবর্তে এখন তাকে অন্তত প্রকাশ্যে অনেকটা এড়িয়ে চলা হচ্ছে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বিরোধিতা বরদাস্ত করতে পারেন না। ব্লগার, ধর্মীয় নেতা, নারী অধিকারকর্মী – তিনি রক্ষণশীল বা উদারপন্থী যাই হোন না কেন – যুবরাজের বিরোধিতা করলেই গ্রেফতার হয়েছেন। এমবিএস সৌদি আরবে নিওম নামে লোহিত সাগরের তীরে যে নতুন বিনিয়োগ নগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছেন তা কতখানি সফল হবে তা নিয়ে অনেকের সংশয় আছে।

তবে সৌদি আরবের ভেতরে যুবরাজ সালমান এখনো খুবই জনপ্রিয়। একজন ভাষ্যকার বলছেন, ‘১৬ থেকে ২৫ বছরের সৌদিরা তাকে একজন হিরো বলে মনে করে যিনি দেশে পরিবর্তন এনেছেন, ধর্মীয় মৌলবাদীদের ক্ষমতা খর্ব করেছেন।’  এমবিএস সৌদি আরবে গণতন্ত্র নিয়ে আসবেন, এমন কোন লক্ষণ কোথাও নেই। তার ঘনিষ্ঠরা মনে করেন, খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে ঝড় উঠেছে তা একসময় ঝিমিয়ে পড়বে। এক দিক থেকে বলা যায়, এমবিএস-ই সৌদি আরব, তিনি কোন গণতন্ত্রী নন, কোন রাজনৈতিক সংস্কারকও নন – অনেকের চোখে তিনি একজন একনায়ক মাত্র। তবে এটাও ঠিক যে তিনি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক আধুনিকায়ন করছেন।

তাছাড়া তার বয়েস মাত্র ৩৪ – তাই তিনি যখন বাদশাহ হবেন, তখন তিনি হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম এই দেশকে ৫০ বছর ধরে শাসন করবেন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *